এনার্কি বা নিরাজ সমাজের পক্ষে

দুনিয়ার প্রায় জায়গায়ই এনার্কিস্ট একটি ইবলিসি শব্দ- এর অন্য নাম শয়তানী, বিচ্যুতি ও ঝগড়া ফ্যাসাদ। অনেকেই মনে করেন এরা ধনিদেরকে মেরে তাঁদের টাকা পয়সা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগী করে নিবে। সরকার থাকবে না, এরা এক ধরনের সরকার বিহীন বিশৃংখল সমাজ গড়তে চায়। আসলে এনার্কিস্টরা এসবের কোনটিই নয়। এরা সত্যিকার অর্থেই মানুষের ব্যাক্তিগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চায়।

Submitted by akmshihab on March 24, 2018

এনার্কি বা নিরাজ সমাজের পক্ষে

এ কে এম শিহাব

এনার্কি কথার এমন ভাগ্য যে এটা শুনলেই অনেকেই আঁতকে উঠেন - ভাবেন এই বুঝি সর্বনাশ হল, মারামারি কাটাকাটির এক দৃশ্য কল্পনা করেন অনেকেই। তারা মনে করেন ধনীদেরকে হত্যা করে তাঁদের সকল সম্পদ কেড়ে নিয়ে বোধ হয় অন্যদেরকে দিয়ে দিবে এনার্কিস্টরা ।

দুনিয়ার প্রায় জায়গায়ই এনার্কিস্ট একটি ইবলিসি শব্দ- এর অন্য নাম শয়তানী, বিচ্যুতি ও ঝগড়া ফ্যাসাদ। অনেকেই মনে করেন এরা ধনিদেরকে মেরে তাঁদের টাকা পয়সা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগী করে নিবে। সরকার থাকবে না, এরা এক ধরনের সরকার বিহীন বিশৃংখল সমাজ গড়তে চায়। আসলে এনার্কিস্টরা এসবের কোনটিই নয়। এরা সত্যিকার অর্থেই মানুষের ব্যাক্তিগত স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চায়।

যদি ও এখন পর্যন্ত রাস্ট্রপন্থী লোকেরা ‘এনার্কিস্ট বা নৈরাজ্য’ শব্দার্থটি অসুস্থ্যভাবে সমাজের সামনে হাজির করেছে, আর সাধারন মানুষ ও ভাবেন যে, তারা পরিচালিত হন আইন দ্বারা, নিয়ন্ত্রিত হন কোন না কোন কর্তৃ পক্ষ দ্বারা তাই রাষ্ট্র একটি দরকারী বিষয়। এনার্কি বা নৈরাজ্য বর্জনীয়।

শতাব্দির পর শতাব্দী ধরে মানুষ দেখে এসেছে যে তারা কোন পার্থিব বা অপার্থিব নিয়ন্ত্রক দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছে, যারা মানতে চায়নি তাদেরকে পাগল হিসাবে চিহ্নিত করে হয় পাগল খানায় পাঠিয়েছে নয়ত বিচার করে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছে; অথচ আজকের দুনিয়ায় শত সহস্ত্র মানুষ সেই সব নিয়ন্ত্রককে অস্বীকার করে দিব্যি জীবন যাপন করছেন ।
আজকের বিশ্বের মুক্ত চিন্তার বহু লোক আছেন, যারা এখনো বিশ্বাস করেন যে রাষ্ট্র একটি দরকারি প্রতিস্টান, সমাজের সুরক্ষার জন্য এর খুবই দরকার; তারা সেই নিস্টুর প্রতিস্টানটির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে ও আগ্রহী নয়। তারা বুঝেনা বা বুঝতেই চান না যে কোন সরকারই নিপিড়ন নির্যাতন না চালিয়ে ঠিকে থাকতে পারেনা; প্রতিটি সরকার প্রতিনিয়ত গভীর নোংরা ও জগন্য অপরাধে লিপ্ত যা সমাজ বিরোধী। সরকারে জন্মই হয়েছে রাজতন্ত্র, গৌস্টিতন্ত্র এবং স্বৈরাচারীদের কর্ম থেকে; ইহা সকল সময় ই স্বল্প মানুষের একনায়ত্ব বহাল রেখে চলে এসেছে।

এটা কে অস্বীকার করতে পারেন যে আমাদের সমাজে প্রচুর সংখ্যক মানুষ আছেন যারা সমাজের ভালোর জন্য চিন্তা করেন না? কিন্তু তাঁদের চিন্তার কোন প্রকার প্রতিফলনই রাষ্ট্রীয় পরিচালনায় ব্যবহার হয় না । সাধারন মানুষের ও মুক্তি আসেনা। প্রচলিত রাষ্ট্রের পদ্বতীতেই এই সকল চিন্তাশীল মানুষের ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই।

লোকেরা জিজ্ঞাসা করেন, “ সরকার ছাড়া আমরা একা কেমন করে চলব?” এই সরকার যদি খারাপ হয়, আসুন ভালো সরকার প্রতিস্টা করি, কিন্তু সরকার ছাড়া আমাদের যে চলেতেই পারেনা !”

আসল সমস্যাটাই হলো সেইখানে- ভালো সরকার বলে আসলে কোন জিনিষ নেই, সরকার ব্যবস্থাটাই হলো একটি শ্রেনীর উপর আরেকটি শ্রেনীর প্রভূত্ব কায়েম করা। লোকেরা বলে, “আমাদেরকে তো কারো না কারো অধীনে থাকতেই হবে”, “তাদেরকে ও আইনের অধীনে রাখা চাই”। ঠিক আছে, আমরা যদি মানুষকে শিশু মনে করি তবে অন্যের নিয়ন্ত্রনে থাকা কারাপ নয়, কিন্তু যারা জ্ঞানী, যাদের নিজেই চলার যোগ্যতা আছে তাঁদের তো অন্যের অনুসরনের দরকার নেই।
আমরা নিবেদন করতে চাই মানুষ নিজেই নিজেদেরকে ব্যাক্তিগতভাবে পরিচালনা করতে সক্ষম। যদি লোকেরা অপরিপক্ষ হয়, তবে শাসকগন ও অপরিপক্ষ। এক জন ব্যাক্তি বা স্বল্প সংখ্যক কিছু ব্যাক্তি, লক্ষ কোটি মানুষকে কি অন্দ্বকরে জাতি বানিয়ে পরিচালনা করছে না ?

একজন বন্দ্বু বললেন, “ তবে আমাদের নুন্যতম কিছু পরিচালনা কারী দরকার”। তা অবশ্যই, এবং সেই ব্যবস্থা তো আমাদের আছেই; এটা স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মাঝে সেই নিয়ম নীতি আছে, আর এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়েই আমাদের এই বিশ্ব সমাজ গড়ে উঠেছিলো। আমরা বুঝি আর না বুঝি আমরা কিন্তু সেই নিয়ম মেনেই আমাদের অস্থিত্ব বজায় রেখে চলেছি; আমার সেই নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য, আর সেই নিয়ম মেনে চলতে আমাদের কোন ভাবেই গায়ে লাগে না । আইন মানার বাধ্যবাদকতা এখন ভিন্ন রকম দাসত্বে রূপ নিয়েছে, আইন প্রনেতারা এখন আমাদের নিয়ন্ত্রক সেজে বসেছেন; কিন্তু প্রাকৃতিক আইন আমাদের বাহিরে চাপিয়ে দেয়া ছিলো না- তা ছিলো সমাজের ভেতর স্বাভাবিক ভাবে গড়ে উঠা বিধি বিধান; আমরা বাঁচি, আমরা জীবন যাপন করি, আমরা চিন্তা করি, আমরা চলাফেরা করি সেই আইনের ভেতর দিয়েই; সেই বিধি বিধান বা আইন কানুন আমাদের শত্রু নয় আমাদের উপকারী ব্যবস্থা।

মানুষ আইন তৈরী করে, সংবিধান থেকে আইনের উদ্ভব ঘটে, এই সকল ক্ষেত্রে কি মানব চরিইত্রের স্বাভাবিক বিষয় গুলো বিবেচনায় নেয়া হয়? সত্যিকার অর্থে আইন প্রনেতারা এর তোয়াক্কাই করেন না, বরং অনেক ক্ষেত্রে এর বিরুদ্বেই স্পর্ধা দেখাতে ভালোবাসেন। ফলে আইন মানুষের শান্তির বদলে অশান্তি ডেকে আনে। মানুষকে মুক্তি দেবার বদলে আরো বন্দিত্বে আবদ্ব করে দেয়।

আমরা যখন দেখি খুব তিক্তভাবে নিরাজ সমাজের বিরুধিতা করেন, কারন এনার্কিস্ট বা নিরাজ সমাজ প্রচলিত সকল ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে দিতে চায়, যা অনেকেরই স্বার্থে আঘাত লাগতে পারে তাই ইর্শাপরায়ন হয়ে এনার্কিজমের বিরুদ্বে বিরূপ প্রচারনা চালায়।

পর কালে বিশাল পুরস্কার প্রাপ্তির লোভ দেখিয়ে গরিব মানুষকে ধর্য্য ও ত্যাগ স্বীকারের উপদেশ দেয়া হয়। বলা হয় গরীবের জন্য আকাশের দরজা বেশী উন্মুক্ত, অথচ তারা এক টুকরো রুটির জন্য আহাজারী করে ও কিছু পায় না ; বাস্তবে ধনীদের জন্য ই প্রাচুর্য্য ভরপুর হয়ে থাকে। তা হলে কি ধনীদের জন্যই আকাশের দরজা বেশী খোলা রাখা আছে? সাধারন মানুষের দুঃখ দুর্দশার সামনে এই ধরনের উপদেশ মালা উপহাস হিসাবেই পরিগণিত হয়ে থাকে।

আমি বহু জ্ঞানি গুনি নারী পুরুষের সাথে কথা বলে দেখেছি, তারা সত্যিকার অর্থে কেহই রাষ্ট্র-সরকারী ব্যবস্থার সমর্থক নয়; সরকারী ব্যবস্থার উচ্ছেদ হোক তারা ও তা চান, কিন্তু তাঁদের মনের জোর খুবই কম, যখন বলা হয় আসুন আমরা মিলিত ভাবে এর বিরুতা করি এর বিলয় ঘটাই, এবং নিরাজ সমাজ কায়েম করি- তখন তারা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যান।
আমরা যারা রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুধীতা করার পথে হাঁটছি এবং দাবী করছি সকল মানুষের সমান অধীকার চাই, সকলের জীবন সুন্দর ভাবে উপভোগের সুযোগ চাই। এটা আমাদের জীবনের মিশন।

মানুষ যখন প্রচলিত রক্ষনশীল ও নিপিড়ক ব্যবস্থার ভেতর থেকে মুক্তি পাবে, তখন মানুষ এক স্বাধীন সম্পর্কে যুক্ত হবে; তখন দুনিয়ার চারিদিকে নয়া নয়া সংগঠন দ্রুত গড়ে উঠবে। প্রতিটি মানুষ সকলের কল্যানে নিজের শক্তি সামর্থ নিয়ে মাঠে কাজ করবেন, সেই সময়েই সকলে তাঁদের চাহিদা মত সকল কিছু পাবেন। সকল আধুনিক উদ্ভাবন ও যন্ত্রপাতি মানুষের উপকারে বিনিয়োগ করা হবে, এতে সকলের কাজ কর্ম সহজ ও আনন্দপূর্ন হয়ে উঠবে, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি, শিল্প-কলা সকল কিছু ই সাধারন মানুষের নাগালের মধ্যে এসে যাবে। সেই সময়েই সকল নারী পুরুষ সত্যিকার অর্থে সমান সমান হয়ে উঠবেন।

লোকেরা তখন বলবেন, “ মানুষ ফেরেশতা নয়, আবার আত্মকেন্দ্রিক ও নয়”।

আত্মকেন্দ্রীকতা কি ? না, এটা কোন অপরাধ নয়; এটা তখনই অপরাধ হয় যখন নিজের স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে অন্যের স্বার্থ নষ্ট করা হয়। এনার্কিস্ট বা নিরাজ সমাজে প্রতিটি ব্যাক্তি তাঁর ইগোর পূর্নতা দিবে; কিন্তু প্রকৃতিতে এমন এক ব্যবস্থা চালু আছে যে কেবল নিজের উপর নির্ভর করে ঠিকে থাকা মুশকিল। নিজের চাহিদা মেটাতে প্রতিবেশী, মানুষ ও অন্যান্য জিনিসের উপর নির্ভর করেই ইগোকে পূর্ন করা যায়, কাউকে সাহাস্য করলে নিজেও সাহায্য পাওয়া যায়, তবে আত্মকেন্দ্রীকতা বা আত্মস্বার্থবাদিতা কোন অভিশাপ নয়, এটা এক প্রকার আশির্বাদ।

এক হাতে চুরি, অন্য হাতে মশাল আর জ্যাকেটের পকেটে রয়েছে বোমা আর ককটেল – এই ভাবেই একজন এনার্কিস্ট বা নিরাজ পন্থীকে তাঁর শত্রুরা চিত্রিত করে থাকে। তারা এদেরকে সাধারন ভাবে বুদ্বিহীন ও দুর্বৃত্ত হিসাবে দেখে থাকে, তারা ভাবে এনার্কিস্টরা দুনিয়াকে উলট-পালট করে দিবে, তারা আরো ভাবে এনার্কিস্টদের সাথে যারা ভিন্নমত ও পন্থী হবে এদের সকলকে হত্যা করা হবে। আসলে এটা হচ্ছে একেবারেই একটি নিকৃষ্ট প্রকৃতির ব্যাঙ্গ চিত্র। সাধারন ভাবে আমরা মানুষকে বিচলিত করতে চাই না, আমরা আমাদের ধারনা গুলো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। তবে আমরা বিশ্বস করি নিরাজ সমাজে – যা অন্যের ক্ষতি না করে নিজের সকল প্রকার স্বাধীনতাকে নিশ্চিত করে। কিন্তু তা যদি হয় সংগঠিত সরকার বা ব্যাক্তি – তবে চাপ প্রয়োগ করা ছাড়া বিজয় অর্জন করা যাবে না। মল্লযোদ্বে বা ম্যারাথনে বিজয়ী হতে গেলে তো কিছু ঘাম ঝড়ানোর বিকল্প নেই।

আগের যে কোন সময়ের তুলনায় মানুষের মুক্তির লড়াই এখন অনেক পরিস্কার ও শক্তিশালী, লক্ষ্য অর্জনের জন্য পথ ও পন্থা এখন অনেক অনুকূল ও সহজ। ঐতিহাসিক বিবর্তনের ধারায় দেখা যায় দাসত্বে আবসান ঘটেছে, নিপিড়নের ধরন বদল হয়েছে, মানুষ এখন অনেক মুক্তভাবে কাজ করতে পারে, সামগ্রিক মুক্তির লড়াইয়ে সফলতা কঠিন হবে না, সামগ্রীক মুক্তি আসবেই।

নিরাজ সমাজের জন্য সংগ্রাম কোন ক্ষতিকারক আন্দোলন নয়, এটা মানুষের সার্বিক মুক্তির লড়াই ও নয়া দুনিয়া গড়ে তুলার রাজ পথ।

আমরা মনে করি, জনগন কোন ভাবেই তাঁদের আন্দোলন সংগ্রামের কথা গুলো একেবারে ভূলে যাবে না, তারা সেই গুলো তাঁদের আগামী দিনে তাঁদের প্রচার প্রপাগান্ডা, আলোচনা ও বিপ্লবী দলিল পত্রে ব্যবহার করবেন।

মানুষ সাম্যবাদ থেকে অগ্রসর হয়ে পরবর্তী ধাপে উন্নিত হবে। সাম্যবাদে যুক্তিক ভাবে প্রভূ ও প্রজার স্থান নেই, যা নৈরাজ্যবাদ বা নিরাজ সমাজের কথাই বলে, যা একটি সমাজ বিপ্লবের বার্তা প্রদান করে থাকে ।

সাধারন ভাবে একটি ধারনা প্রচলিত আছে যে নৈরাজ্যবাদিগন সহিংস প্রকৃতির হয়ে থাকে, নিরাজ সমাজ পন্থীরা ও এটা অস্বীকার করেন না যে “সহিংসতার” পথ বেচে নিতে নিপীড়িত মানুষ কোন কোন সময় বাধ্য হয় নিজেদের স্বাধীকার অর্জনের জন্য। নিপীড়িত আওয়াম জনগনের বিদ্রোহকে স্বৈরশাসকগন সকল সময়েই নিন্দাবাদ করে এসেছে; গ্রীসের পার্সিয়া এস্টোন্ড, রোমের কুদিন ফর্ক, এবং ইংল্যান্ডের ব্যাংকার হিল ইত্যাদি উল্লেখ যোগ্য উদাহরন। এনার্কিস্ট বা নিরাজ পন্থীরাকি এর কোন ব্যাতিক্রম আশা করতে পারে, বা লড়াই সংগ্রাম ছাড়া কোন প্রকার বিজয় আশা করতে পারে ?

Comments