এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমঃ তত্ত্ব ও প্রয়োগ (প্রথম কিস্তি)

এনার্কিজম বা নিরাজবাদ হলো আমাদের সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ন বুদ্বিবৃত্তিক রাজনৈতিক চিন্তার শ্রুতধারা, যা তাঁর অনুসারীদের মধ্যে অর্থনৈতিক একচাটিয়াবাদ, রাজনৈতিক এবং সামাজিক নিপিড়ন মূলক প্রতিস্টানের বিলয় ঘটিয়ে দিতে চায়। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি ‘মুক্তসমিতির ফেডারেশনের’ মাধ্যমে সকল প্রকার উৎপাদন পদ্বতি পরিচালনা করবে, যার লক্ষ্যই হবে সমাজের প্রতিটি সদস্যের চাহিদা মেটানো, তা কোন ভাবেই প্রচলিত সমাজের স্বল্প সংখ্যক মানুষের সুবিধা ভোগ ও নিয়ন্ত্রন চলতে দিবে না।

Submitted by akmshihab on May 6, 2018

এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমঃ তত্ত্ব ও প্রয়োগ

মুল লিখকঃ রুডলফ রকার

অনুবাদঃ এ কে এম শিহাব

এনার্কিজম বা নিরাজবাদঃ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য

(প্রথম কিস্তি)

এনার্কিজম বা নিরাজবাদ হলো আমাদের সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ন বুদ্বিবৃত্তিক রাজনৈতিক চিন্তার শ্রুতধারা, যা তাঁর অনুসারীদের মধ্যে অর্থনৈতিক একচাটিয়াবাদ, রাজনৈতিক এবং সামাজিক নিপিড়ন মূলক প্রতিস্টানের বিলয় ঘটিয়ে দিতে চায়। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে একটি ‘মুক্তসমিতির ফেডারেশনের’ মাধ্যমে সকল প্রকার উৎপাদন পদ্বতি পরিচালনা করবে, যার লক্ষ্যই হবে সমাজের প্রতিটি সদস্যের চাহিদা মেটানো, তা কোন ভাবেই প্রচলিত সমাজের স্বল্প সংখ্যক মানুষের সুবিধা ভোগ ও নিয়ন্ত্রন চলতে দিবে না। প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থায় যে প্রানহীন যান্ত্রিক আমলতন্ত্র চলছে তার পরিবর্তে স্বাধীন ও মুক্ত মানুষের সংস্থা গড়ে তুলবে, তবে সকলে সকলের সাথে সামাজিক ও অর্থনৈতি স্বার্থে পারস্পরিক বন্দ্বনে আবদ্ব থাকবে, এবং স্ব স্ব কর্ম সম্পাদনের জন্য তাঁরা স্বাধীন ও স্বেচ্ছাকৃত চুক্তির আওতায় জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে উঠবেন।

প্রচলিত অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি গভীর ভাবে অধ্যয়ন করলে এটা পরিস্কার হয়ে উঠে যে, নিরাজবাদ কোন কল্পনা বিলাশী চিন্তক সংস্কারবাদির ধারনা নয় বা আলস চিন্তার ফসল নয়। এটা হলো সম্পূর্ন যুক্তিভিত্তিক বাস্তব সম্মত, ও প্রয়োগ যোগ্য একটি জীবন ব্যবস্থার নাম। যা মানব সমাজকে একটি নয়া ব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাবে। সামগ্রীক ভাবে উন্নিত করবে অন্য এক নয়া স্তরে। প্রচলিত একচাটিয়াবাদ, পুঁজিবাদ, এবং কর্তৃত্ববাদি রাষ্ট্র ব্যবস্থা মানুষের জন্য কেবল দুঃখ আর যন্ত্রনাই ডেকে আনছে। মানুষের কষ্ট লাগবে তেমন কোন ভূমিকাই রাখতে পারছে না । যুদ্ব, খুন আর রক্তপাত নিত্যদিনের ঘটনা।

বর্তমান অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থায় মাত্র কিছু মানুষের হাতে সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে পড়ে। স্বল্প সঙ্খ্যার সুবিধা ভোগী মানুষেরা ক্রমাগত ভাবে সাধারন মানুষকে নিঃস্ব থেকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। ফলে মানুষের মাঝে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিদ্রোহের সৃষ্টি হলে, তাঁরা তা নানা কৌশল অবলম্বন করে তাদেরকে দমিয়ে রাখার প্রায়স চালায় । এই ব্যবস্থা সামাজিক স্বার্থকে ব্যাক্তি স্বার্থের নিকট বলি দিয়ে দেয়, তা ও করে একটি বিশেষ আইনী কাঠামোর ভেতর দিয়ে। এরা মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ককে উপেক্ষা করে । মানুষ ভুলে যাচ্ছে যে, শিল্পকারখানা কোন চূড়ান্ত বিষয় নয়, জীবনের শেষ পাওয়া ও নয় বরং এটা হলো মানুষের সুন্দর জীবন যাপনের একটি উপায় মাত্র, মানুষকে একটি উন্নত সংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে প্রবেশ করতে হবে। প্রচলিত ভাবনা মানুষকে আবিস্ট করে রেখেছে এমন ভাবে যে, তাঁরা ভাবতে শুরু করেছে, মানুষ কিছুই নয় শিল্প কারখানাই সব কিছু, ফলে একটি নির্দয়, নিস্টুর, দয়া, মায়াহীন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। আর রাজনৈতিক পরিবেশ ও সেই ধারায় আবর্তিত হয়ে চলেছে। এই গুলো পরাস্পরিক সমন্বয়ে পরিচালিত হয় এবং একেই বৃত্তে আবর্তিত হয়।

অর্থনৈতিক একচাটিয়াবাদ কায়েম করে একনাকত্ব আর রাজনৈতিক একনাকত্ব ডেকে আনে স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার। উভয়ই সামাজিক উদ্দেশ্যে প্রবৃদ্বি ঘটিয়ে থাকে, এই উভয় উপাদান সমূহ ই সামাজিক ভাবে জীবন কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার বিপরিতে যান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করে থাকে। ছন্দপতন ঘটায় মানবিক জীবনের। আমাদের আধুনিক সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিটি দেশের সমাজ ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিয়েছে, নানা ভাবে সামাজিক অসন্তোষ ও বিদ্রোহের জন্ম দিয়ে চলেছে, সমাজের চলমান সাংস্কৃতিক কাঠামোকে ভেঙ্গে চুরমার করে ফেলেছে; আমাদের জাতীয় ও সামাজিক জীবনে নানা প্রকার সাম্প্রদায়িকতার উন্মেষ ঘটাচ্ছে। আমাদের হাজার বছরের লালিত সম্প্রীতির পরিবেশ ধ্বংস করে দিয়েছে। বিগত বিশ্ব যুদ্বের পর থেকে রাজনৈতিক শক্তি সমূহের মাঝে চলছে হানাহানি, দুনিয়া জুড়ে চলছে একপ্রকার মরন লড়াই, তা প্রায় সকল মানুষকেই কোন না কোন ভাবে প্রভাবিত করছে, এই ধরনের নিস্ফল অনন্ত লড়াই ও যুদ্বের সত্যিকার কোন যুক্তি নেই, যা আমাদেরকে এক প্রকার অপ্রত্যাশিত মহা দুর্যোগের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যদি সামাজিক কোন উন্নয়ন প্রক্রিয়ার উদ্যোগ গ্রহন করা না হয় তবে এই অবস্থার অবসান হবার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছে না । এই পরিস্থিতির কারনে কোন কোন দেশে সামরিক ব্যয় ৮০% থেকে ১০০%+ বাজেট বৃদ্বি করে চলেছে। সামরিক প্রতিরক্ষার নামে বিপুল খরচ করার কারনে যেমন বাড়ছে জাতীয় ঋনের বোঁজা অন্য দিকে সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে দেশের সাধারন মানুষ।

প্রানহীন ও যান্ত্রিক আমলাতন্ত্র মানুষের জীবন যাত্রা সহজী করনের পরিবর্তে সামাজিক জীবনে বিভক্তি সৃষ্টি করছে, এরা পারস্পরিক সহযোগীতার ক্ষেত্রকে দুষিত করে দিয়েছে, ফলে সামাজিক উন্নয়নের নয়া পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না । প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতিটি পদক্ষেপ এমন যে, এটা মানুষের মাঝে বিরাজমান পারস্পরিক কল্যাণ কামিতার মনোভাবকে তিরোহিত করে সামাজিক বন্দ্বনকে নষ্ট করে দেয়, এবং এক শ্রেনীর লোক এই সুযোগে ক্ষমতার লোভ লালসাকে চরিতার্থ করতে অর্থ সম্পদ ও ঐতিহ্যকে স্বীয় স্বার্থ উদ্দারের লড়াইয়ে পরস্পরের বিরুদ্বে ব্যবহার করছে। এই ব্যবস্থাটি অনেক ক্ষেত্রেই শান্তির পথ হিসাবে তথাকথিত বড় বড় বুদ্বিজীবীগন আজ কাল দেখাতে চাইছেন, অথচ এটা হলো এক ধনের আধুনিক ফ্যাসিবাদ, সামাজিক ক্ষমতা কাঠামোকে অবদমন করে নিজেদের নিরংকুশ রাজত্ব কায়েম করে রাষ্ট্রের নামে সকল ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রন বজায় রাখতে চায়। এটা অনেকটা ধর্মীয় ভাবধারার মত, সেখানে বলা হয় সকল কিছুর নিয়ন্ত্রন ইশ্বরের আর এখানে বলা হয় সকল প্রকার নিয়ন্ত্রন রাষ্ট্রের নিকট, মানুষ কিছু নয়; কিছুই করার ক্ষমতা নেই মানুষের। যা ঘটে সবই হয় “প্রভুর ইচ্ছায়”। আর আজ বলায় হচ্ছে যা ঘটে তা হয় “রাষ্ট্রের ইচ্ছায়”। আদতে এই সকল ব্যাখ্যা সম্পূর্ন ভাবে এক শ্রেনীর কায়েমী স্বার্থবাদি চক্রের ব্যাখ্যা । এই ধরনের ব্যাখ্যা সত্যিকার জ্ঞানকান্ড থেকে বহু দূরে অবস্থিত।

এনার্কিস্ট বা নিরাজবাদি ধারনার ইতিহাস বেশ দির্ঘ, তবে তা এখনো নানা ভাবে মাঠ পর্যায়ে গবেষণার দাবী রাখে। আমরা এখানে চিনের প্রখ্যাত চিন্তক লাওতসের কথা বলতে পারি, এবং তাঁর পরবর্তীতে গ্রীক দার্শনি হেডনিস্ট এবং সিননিক্স যারা “প্রকৃতিক অধিকার” নিয়ে কথা বলেছেন, তাঁরা জেনুতে প্ল্যাতোর পাশাপাশি স্টোইক স্কুল প্রতিস্টা করেছেন। তাঁরা সেখানে আলেকজান্দ্রীয়াতে নোইস্টিক ও কারপোক্রেটের শিক্ষায় অভিষিক্ত হয়ে প্রচারনা কালে ফ্রান্স, জার্মানী,হল্যান্ড প্রভৃতি দেশে মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান যাজকদের নিপিড়নের শিকার হন। বোহেমিয়ানদের সংস্কার আন্দোলন কালে ও তাঁরা পিটার চিল্কির চিন্তার সাথে পরিচিত হন, যার কাজের ও চিন্তার ক্ষেত্র ছিলো, “বিশ্বাসের মানবিক সম্পর্কের বুনন” তাঁদের সাথেও চার্চ ও রাষ্ট্রের কর্তা লোকেরা একেই ব্যবহার করেছে। লিও টলস্টয়ের সাথে ও একেই আচরন করেচিলো তাঁরা সেই মুর্খ চক্র । মহান মানবতাবাদিদের মধ্যে একজন ছিলেন রেবেলিস, তিনি সুখি জীবন যাপনের জন্য তেলেমে হেপী এব্বে তে যে বর্ননা দিয়েছিলেন, যার মুল কথা ছিলো সকল প্রকার কতৃত্বতান্ত্রিকতা থেকে মানুষে মুক্তি। উদারবাদী ভাবধারার অন্য অগ্রগামীদের মধ্যে আমরা এখানে কেবলমাত্র লা বোয়েটি, সিলভাইন মারেচ, এবং সর্বোপরি, ডিডরোটের কথা উল্লেখ করব, যার প্রখ্যাত গ্রন্থগুলির মধ্যে সত্যিকারের একটি মহান কথা নিবিড়ভাবে আবিষ্কৃত হয়েছে, তা হলো, কোন কর্তৃত্ববাদীই নিপিড়ন মুলক কার্যক্রম থেকে মুক্ত ছিল না ।

এদিকে, সাম্প্রতিক কালে নিরাজবাদি ধারনা সামাজিক বিবর্তনের ধারায় প্রয়োগ করার জন্য চিন্তাশীল সমাজবাদিদের মধ্যে প্রকট হচ্ছে। ১৭৯৩ সাল, লন্ডনে, এই ধরনের কিছু ভালো উদ্যোগ লক্ষ্য করা গেছে উইলিয়াম গডউইনের কাজে, রাজনৈতিক ন্যায় বিচার, সামাজিক মানুষের শান্তির বিষয় গুলো প্রাধান্য পেয়েছে। আমরা বলতে পারি, গডউইনের কাজ ছিল, এটা দেখানো যে, ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক ও সামাজিক চরমপন্থার ধারণাগুলির যে দীর্ঘ বিবর্তনের ইতিহাস যার ফল শ্রুতিতে এই ধারনার উন্মেষ হয়েছে। যা রিচার্ড হুকার, জেরার্ড উইনস্টিনলি, অ্যালগরনন সিডনি, জন লকে, রবার্ট ওয়ালেস, এবং জন বেলার্স থেকে জেরেমি বেন্টহাম, জোসেফ প্রিস্ট্লি, রিচার্ড প্রাইস, এবং টমাস পেইন প্রমুখ সকলেই একমত ছিলেন। গডউইন খুবই সাহসীকতার সাথে মতামত দিয়েছিলেন যে, সামাজিক শয়তানীর কারণটি “রাষ্ট্রের আকারে নয়, বরং তার অস্তিত্বের মধ্যে অনুসন্ধান করতে হবে”। ঠিক যেমন রাষ্ট্র প্রকৃত সমাজের একটি নক্সা প্রদর্শন করে, তেমনি এটি মানুষকে তাদের অনন্ত অভিভাবকত্বের অধীনে রাখে, যা তাদের প্রকৃত আত্মার নিছক কণ্ঠস্বর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করে এবং তাদের স্বাভাবিক প্রবণতাগুলি দমন করে ও তাদের কাজে এমন জিনিসগুলি ধারণ করে যা প্রতিহিংসামূলক নয় বরং ইহা তাদের অভ্যন্তরীণ প্রেরনা । শুধু এই ভাবেই ভালো নাগরিক হিসাবে গড়ে তুলার জন্য মানুষকে একটি ছাঁচে ফেলা দরকার। যখন কোন সাধারন মানুষকে কোন প্রকার বাঁধা বিপত্তিতে ফেলা হয় না, বা বাঁধা প্রাপ্ত করা হয় না, সে যখন স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে পারে, তখন তাঁর স্বাভাবিক বিকাশ ঘটে।

গডউইন দেখিয়েছেন, মানুষ কেবল সম্মিলিত ভাবে সামাজিক জীবন যাপন করতে পারে, যদি তাঁর উপর কোণ প্রকার কর্তৃত্ববাদ বা অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রন আরোপ করা না হয় । যতক্ষন পর্যন্ত তাকে প্রজা বানিয়ে শোষন করা না হয় ততক্ষন সে স্বাধীন ও মুক্ত জীবন যাপন করে। কোন প্রকার চরম পন্থার দিকে প্রায়স অগ্রসর হয় না । তাই আমরা প্রস্তাব করি রাষ্ট্র যত বেশী প্রভাব বিস্তার করা থেকে বিরত থাকবে ততই মঙ্গল হয় নাগরিক সমাজের। গডউইনের মতবাদই হলো, রাষ্ট্রবিহীন সমাজ এবং সকল প্রকৃতিক সমপদের উপর সমাজের মালিকানা কয়েম করা, এবং অর্থনৈতিক জীবন যাপনে সম্মিলিত উৎপাদন ব্যবস্থার প্রবর্তন করা; এই অর্থে গডউইনকে সমাজতান্ত্রিক নিরাজবাদের জনক বলা যায়। গডউইনের কর্মের শক্তিশালী প্রভাব পড়েছিলো ইংরেজ শ্রমজিবী মানুষ ও তাঁদের উদার পন্থী বুদ্বিজীবী মহলে। তাঁর বড় অবদান হলো, তিনি ইংলিশ সমাজে তরুন সমাজের মাঝে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা করতে পেরেছিলেন। সেই আন্দোলনে যারা বিশেষ ভূমিকা রাখেন তাঁরা হলেন, রবার্ট ওয়েন, জন গেরী, এবং উইলিয়াম থমচন, যাদের মাঝে মুক্তিবাদি একটি চেতনা বিরাজ করত, যা আমরা জার্মানী বা অন্যান্য দেশে দেখতে পাইনা ।

তবে, নিরাজবাদ বা এনার্কিজম বিনির্মানের ক্ষেত্রে পেরী জুসেফ প্রুদ র প্রভাব ও ছিলো ব্যাপক হারে সমগ্র ইউরূপ জোড়ে, তিনিবুদ্বি বৃত্তিক জগতে আধুনিক সমাজতন্ত্রকে অধিকতর শক্তিশালী করে গেছেন। প্রুদোয়ান চিন্তার প্রতিফলন আমরা সেই সময়ে দেখতে পাই বুদ্বিজীবী ও সামজিক জীবনে, তিনি সকল সামাজিক জিজ্ঞাসার উত্তর দিয়ে দিয়ে এই মতবাদকে পরিপূর্নতা দানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। তাই, তাঁর মূল্যায়ন করতে হলে, তাঁর অগনিত অনুসারীদের দিকে নজর দিতে হবে, যারা তাঁর সমসাময়িক ছিলেন। তাঁর অগনিত সমাজবাদি অনুসারী চিন্তকগন তাঁর প্রচন্ড অনুরাগী ছিলেন, তাঁরা সকলেই বুঝতে পারতেন যে, সমাজটি অসম বা ভুলভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাঁরা তাঁদের দৃষ্টি ভঙ্গীকে প্রসারিত করে একটি নয়া সমাজের স্বপ্ন ও দেখছিলেন। তিনি প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতিটি অসংগতি নিয়ে খোলাখুলি সমালোচনা করছিলেন। তিনি দেখাচ্ছিলেন, সামাজিক বিবর্তন সমাজের ভেতর থেকেই উত্থিত হচ্ছে যা আমাদের জীবন যাত্রাকে প্রভাবিত করতে পারে, আমাদেরকে একটি উন্নত সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে টেনে নিয়ে যাবে, সেটা কোন কল্পলোকের বিষয় নয়, সেটা বাস্তব সম্মত ও জীবন ধর্মী বিষয়। চিন্তক প্রুদু জ্যাকবিনদের ঐতিহ্যের বিরুধীতা করছিলেন। সেই সময়ে ফ্রান্সের সমাজবাদি ভাবনার জগতে তা ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চলছিলো। যার আলোচ্য বিষয়ই ছিলো কেন্দ্রীয় সরকার ও একচাটিয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং প্রাকৃতিক সামাজিক প্রগতি। তিনি বলছিলেন সমাজকে মুক্ত করতে চাইলে সমাজের ভেতরে বেড়ে উঠা দুটি ক্যানসার কেটে বাদ দিতে হবে- উনবিংশ শতাব্দির বিপ্লবের জন্য তা অতিব জরুরী বিষয়। প্রুদু কমিউনিস্ট ছিলেন না।

তিনি ব্যাক্তিগত সম্পত্তির নিন্দা করতেন, তিনি বলতেন এটা শোষণের হাতিয়ার। তিনি সকল উৎপাদন ব্যবস্থার ও যন্ত্রপাতির মালিকানার শ্রমিকদের জন্য দাবী করেছিলেন। তিনি বলতেন শিল্প কারখানার মালিকানা থাকবে তাঁদের নিকট এরা স্বেচ্ছাকৃত চুক্তির মাধম্যে তা পরিচালনা করবে। কেউ কাউকে শোষণ বা বঞ্চনা করার সুযোগই পাবে না । সকল ক্ষেত্রে মানবিক মার্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের সংস্থা সমূহে সাম্য সমাতা বিরাজমান থাকবে, সকলেই সমান অধিকার, সমসেবা উপভোগ করবেন। কোন পন্যের মূল্য নির্ধারনের জন্য তাঁর উৎপাদন সময়কে বিবেচনায় নেয়া হবে এবং তা বিনিময়ের ক্ষেত্রে ও তা বিবেচ্য হবে। পুঁজি নানা ভাবে মানুষকে শোষণ করে, তাই, কর্ম সময়কে মূল্যায়ন করা হবে- এই প্রক্রিয়ায় তাঁর লাগাম টানা হবে। এই প্রক্রিয়া সকল জায়গায় শোষন যন্ত্রের উচ্ছেদ চলবে। প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রাজনৈতিক নিপীড়ন কে উৎসাহিত করছে। আমাদের সমাজ হবে নানা জাতি গৌস্টির একটি স্বাধীন সম্মিলিত মহাজোট তাঁরা তাঁদের প্রয়োজন ও চাহিদার আলোকে উৎপাদন সহ সকল কিছুর পরিকল্পনা গ্রহন করবে। তাঁরা তাঁদের নিরাপত্ততা নিশ্চিত করবে ও নিজেদের দ্বন্দ্ব নিজেরাই মিটিয়ে নিবে। “ সমাজে স্বাধীন সামাজিক ব্যবসা থাকবে যা সমাজের জন্য ই ভালো হবে”। প্রুদু ফেদারেশনের আওতাভুক্ত সংগঠন সমূহের কর্ম কান্ডকে আগামী বিশ্বের জীবন ধারা হিসাবে দেখেছেন।

সেখানে তিনি ব্যাক্তি মানুষের উন্নত একটি স্বাধীন পরিবেশ চিন্তা করেছে। তিনি উন্নয়নের জন্য সুনির্দিস্ট কোন সীমা ঠিক করেন নাই। তিনি বরং সমাজ ও ব্যাক্তির কাজের উন্নয়নের জন্য বৃহত্তর পরিশরের কথা বলেছেন। তিনি ফেডারেশনের ধারনার উন্মেষ ঘটান, একেই ভাবে রাজনৈতিক ঐক্য ও জাতীয়তাবাদের উত্থানে ভূমিকা রাখেন, সেই সময়ে জাতীয়তাবাদের বিকাশে ম্যাজ্জিনি, গ্যারিবালদি, লেলুয়েল এবং অন্যানি চিন্তকগন ও কাজ করেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি তাঁর সমসাময়িকদের চেয়ে স্পস্ট দূরদৃষ্টি সম্পন্ন ছিলেন। প্রুদ সমাজবাদের উন্নয়ন ও বিকাশে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। তাঁর অবদানে ল্যাতিন আমেরিকার লোকেরা বেশী আলোকিত হয়েছিলেন। কিন্তু তথাকথিত ব্যাক্তিবাদি নৈররাজ্যবাদি, যাদের আমেরিকায় উন্মেষ ঘটেছিলো যেমন, জয়েস ওয়ার্ন, স্টিফেন পিয়ারেল এন্ড্রো, ইউলিয়াম বি, গ্রীন, লিসেন্ডার স্পুনার, ফ্রান্সিস ডি, টেন্ডি এবং বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য ব্যাঞ্জামিন আর, টাকার প্রমুখ একই ধারার লোক। তাঁদের কেহই প্রুদর চিন্তাধারা সাথে একমত হন নাই।

এনার্কিজম বা নিরাজবাদ একটি ব্যাতিক্রম ধর্মী ধারনা পায় ম্যাক্স ট্রেইনেরর নিকট থেকে(জন ক্যাস্পার স্মিথ) ও তাঁর গ্রন্থ সমূহ অধ্যয়ন করে। তাঁর গ্রন্থ ডার এইঞ্জি এন্ড সিন এইজেন্টাম ( দি এগো এন্ড হিজ উওন) প্রকাশিত হবার পর তা তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি, বরং অল্প সময়ের মধ্যেই তা হারিয়ে যায়, নিরাজবাদি আন্দোলনে ও কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি, কিন্ত মজার বিষয় হলো এই বইটি অপ্রত্যাশিত ভাবে প্রায় পঞ্চাশ বছর পর পুনঃ জীবন লাভ করে এবং সর্বত্র সাড়া ফেলে দেয়। স্টেইনারের এই বইটি ছিলো প্রথমিক ভাবে একটি দার্শনিক কাজ। এই কাজের মাধ্যমে তিনি দেখান যে, মানুষ প্রায় ৫০ ধরনের উচ্চতর জিনিষের উপর নির্ভরশীল, সে তাঁর পক্ষে যুক্তি তর্ক দিয়ে কথা বলতে ও দ্বিধা করেনা। এই গ্রন্থটি একটি সচেতনতা মূলক গ্রন্থ যা মানুষকে বিদ্রোহী করতে তুলতে পারে, সমজদার পাঠক যে কোন কর্তৃপক্ষকে অস্বীকার করার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়, তবে এই গ্রন্থ মানুষকে স্বাধীন চিন্তা ভাবনা করার জন্য প্রস্তুত করে তোলে।

Comments

Related content