এরিকো মালাতিস্তা প্রনিতঃ সংগঠন

Submitted by akmshihab on September 1, 2018

এরিকো মালাতিস্তা প্রনিতঃ সংগঠন

অনুবাদঃ অনিক সন্ধি

সংগঠন হল সংহতি এবং একে অপরকে সহযোগীতার চর্চা যা প্রাকৃতিক ভাবেই মানুষের চাহিদা পূরণের জন্য মানুষের দ্বারাই জন্ম নেয় এবং যার দ্বারা কোন সংঘবদ্ধ দল কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের কাজে ব্যবহার করে। যেহেতু কোন একজন মানুষ কখনই নিজে সম্পূর্ণ একা থেকে নিজের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে না তাই স্বাভাবিকভাবেই একের অধিক মানুষ সংঘবদ্ধ হয়ে নানা সংগঠন গঠন করে যার দ্বারা তারা তাদের জীবণধারনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করে। ঠিক এই সংবদ্ধ থেকে দরকারি চাহিদা পূরণের প্রবণতা থেকেই সমাজ নামক সংঠনটি জন্ম নিয়েছে।

যখন দেখা যায় যে একই চাহিদা অথবা চিন্তাভাবনা সম্পন্ন মানুষের গোষ্ঠী সংঘবদ্ধ হতে ব্যর্থ হয় তখন তারা এমন শক্তিশালী সংগঠনের দ্বারা আটক পড়ে যারা অন্যের শ্রম লুটে নিয়ে নিজেদের সম্পদের পাহাড় গড়ে। এগুলোই হল পূঁজিবাদী সংগঠন এবং এদের হাতিয়ার ও রক্ষাকারী হিসেবে যে সংগঠন কাজ করে তা হল রাষ্ট্র। মানবসভ্যতার ইতিহাসে রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় সম্পত্তি রক্ষার জন্য, মানুষের জীবন রক্ষার জন্য নয়। আজ শ্রমিক শ্রেণী সংঘবদ্ধ নয় বিধায় পুঁজিপতিরা তাদের অত্যাচারের যন্ত্র তাদের উপর চালাতে পারছে। একমাত্র নিরাজবাদই এই সমস্যা দূরীকরণ করতে পারে।

যারা সংগঠনের বিরুদ্ধে কথা বলে তারা সবচেয়ে বড় যে ভুল করে তা হল তারা মনে করে যে কতৃত্ব বা শাসন বিহীন কোন সংগঠন থাকতে পারে না। এটা বলাই বাহুল্য যে সংগঠন ব্যক্তি এবং সামাজিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃষ্টিভঙ্গি। কোন একজন ব্যক্তি, যে সামাজিক সংগঠন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন, সে কখনই নিজের মৌলিক চাহিদা গুলো পূরণ করতে পারবে না। মানুষ সামাজিক জীব তাই প্রত্যেক মানুষের বেচে থাকার জন্য একে অপরকে প্রয়োজন। সংগঠন যেহেতু একাধিক ব্যক্তির সংবদ্ধ হয়ে কোন লক্ষ্য পূরণের চর্চা, তাই যারা কিনা সংগঠনের বিরুদ্ধে এবং সংগঠনবাদ ধ্বংস করতে চায়, তাদেরকেও দেখা যায় সংঘবদ্ধ হয়ে এমন সংঠন গঠন করতে যা তাদের সেই লক্ষ্য পূরণে একমত।

আমরা নিরাজবাদীরা একমত যে আমরা এমন সকল সংগঠন সমাজে সৃষ্টি করতে চাই যা সকল কতৃত্ব ও শাসন থেকে মুক্ত। এই সংগঠন গুলোই পূঁজিবাদ, রাষ্ট্র ও সকল অত্যাচারী সংঠনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলবে ও এগুলোর ধ্বংসের পর সেই স্বাধীন সমাজ নির্মাণে ও রক্ষায় এই মুক্তিবাদী সংগঠন গুলো ব্যবহৃত হবে।

একটি স্বাধীন সমাজ গঠনের লক্ষে অবশ্যই নিরাজবাদীদের এক হতে হবে।

একজন রসায়নবিদ, গণিতবিদ অথবা মনোবিদ বলবে যে রসায়ন, গণিত এবং মনোবিদ্যায় কোন সামাজিক কর্মসূচী নেই কেননা এগুলো সত্য প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর। নিরাজবাদ এবং সমাজতন্ত্রের নির্দিষ্ট কর্মসূচি আছে কেননা এগুলো সমাজের আমূল পরিবর্তন আনতে চায়। নিরাজবাদ এবং সমাজতন্ত্র রসায়ন, গণিত এবং মনোবিদ্যার মতন সত্য প্রতিষ্ঠায় চিন্তিত নয়। নিরাজবাদ এবং সমাজতন্ত্র হল কতগুলো প্রস্তাব ও পরিকল্পনা যা আমরা নিরাজবাদী অথবা মুক্তিবাদীরা বাস্তবায়ন করতে বদ্ধপরিকর। তাই এই কারণেই নিরাজবাদকে অথবা মুক্তিকামী সমাজতন্ত্রকে কর্মসূচি হিসেবে প্রণয়ন করতে হবে। এই সকল কর্মসূচী বাস্তবায়নের সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল নিরাজবাদীদের এক হয়ে সংগঠন গঠন করা, যে সকল সংগঠন এসকল প্রস্তাব ও পরিকল্পনাকে কর্মসূচী হিসেবে গ্রহন করবে ও তা বাস্তবায়নে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালাবে।

কতৃত্ববাদ এবং শাসন সংঠনের ফল নয়। বরং সামাজিক অসংগতিই এসবের জন্ম দেয়। যখনই দেখা যায় সমাজে কোন নির্দিষ্ট চাহিদা পূরণের জন্য সেখানকার ব্যক্তিবর্গ সংগবদ্ধ হতে পারছে না অথবা সেই বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান নেই তখন এমন এক কর্তার উদয় হয় যে কিনা তার ক্ষমতা দিয়ে সেই চাহিদা পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দেয় আর সেই উছিলায় সমাজে তার কতৃত্ব স্থাপন করে। সুতরাং দেখাই যাচ্ছে শাসক ও শোষণকারীরা সবসময় চায় যে সমাজে অসংহতি বিরাজ করুক। আর যেহেতু অসংহতির মূল কারণ জ্ঞানহীনতা তাই তারা এটা স্বাভাবিকভাবেই চাবে যে জনগনের মাঝে জ্ঞানহীনতা বিরাজ করুক। একে অপরকে সহযোগীতার মাধ্যমেই আমরা সর্বোচ্চ জ্ঞান আরোহন করতে পারি। আবার জ্ঞান চর্চার মাধ্যমেই আমরা উপলদ্ধি করতে পারি যে সামাজিক শান্তি ও সমৃদ্ধির মূল পন্থা হল সহযোগিতা। সামাজিক অসংতি ও অস্থিরতা যেমন কতৃবাদ ও শাসনের জন্ম দেয় ঠিক তেমনি কতৃত্ববাদ ও শাসন আরও সামাজিক অসংহতি ও অস্থিরতার জন্ম দেয়। তাই দেখা যায় সরকার বা রাষ্ট্র মূল সামাজিক সমস্যাগুলো তো দুরীকরন করতে পারেই না বরং শাসন ও কতৃত্বের মাধ্যমে আরও বেশি সামাজিক সমস্যা সৃষ্টি করে। কতৃত্ববাদী সংগঠন গুলোর কাঠামোই এমন যেখানে যুক্তি, বিচারবুদ্ধি ও সহযোগীতা বর্জন করা হয় এবং এগুলোর বদলে গ্রহণ করা হয় যাজকতান্ত্রিক শাসন ও বিচারবুদ্ধিহীন আদেশ যা সেই সংগঠনের উপরওয়ালা থেকে আসে। যে সমাজ গঠিত হয়েছে এরকম সংগঠনের মিলনে, সেই সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধতা কী করে সম্ভব?

সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে সমাজে কতৃত্ব ও শাসনের দোষ সংগঠনের নয় বরং দোষ অসংগতিরই। অসংগতি এমন এক গোষ্টির জন্ম দেয় যাদের বিশৃঙ্খলাতেই লাভ। সেই শাসক গোষ্টি ঠিক এই কারনেই জনগনকে অনৈক্য রাখতে বদ্ধ পরিকর।

আমাদের স্বাধীনতার মূল হাতিয়ার হবে আমাদের তৈরিকৃত সংগঠনগুলো। এই সকল সংগঠনের মাধ্যমেই আমরা সংবদ্ধ হয়ে সমষ্টিগত কর্মসূচি সম্পাদন করতে পারব এবং যারা আমাদের অসংগতির সু্যোগ নিয়ে আমাদের দমিয়ে রাখে তাদের বিতাড়িত করতে পারব।

বিচ্ছিন্নতা, অনৈক্যতা ও অসংগতি স্বাধীনতা কেড়ে নেয় এবং কর্মদ্যোগকে অসম্ভব করে তোলে। মানুষ তাই সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত স্বাধীনতা পেতে পারে ঐক্যতা, সংগতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে।

নিরাজবাদী সংগঠন সবসময় ব্যক্তিগত যোগাযোগ উৎসাহিত করে যাতে গৃহিত কর্মকাণ্ডগুলো আরও দক্ষতার সাথে প্রণয়িত হয়। নিরাজবাদী কংগ্রেস, ফেডারেশন বা সংগঠনের সিদ্ধান্তসমূহ বাধ্যতামূলক নয় বা জোরপূর্বক কারও উপর চাপিয়ে দেয়ার জন্য নয় বরং সিদ্ধান্তসমূহ হল পরামর্শ স্বরূপ যা সকল মেম্বারের ভালর দিকে খেয়াল রেখে গৃহিত হয়।

আমার মতে একটি নিরাজবাদী সংগঠন এমনভাবে কাঠামোবদ্ধ থাকবে যাতে তা সর্বোচ্চ ব্যক্তি-স্বাধীনতা প্রদান করবে। ব্যক্তি ও একের অধিক নিরাজবাদী সংগঠন স্বাধীনভাবে নিজ ইচ্ছা অনুযায়ী সংবদ্ধ হতে পারবে এবং ইচ্ছা অনুযায়ী সেই সংগঠন থেকে বের হয়ে আসতে পারবে। একের অধিক সংগঠন স্বেচ্ছানু্যায়ী একত্র হয়ে আরো বড় সংগঠন গঠন করাকে বলে ফেডারেট হওয়া এবং ওই বড় সংগঠনটিকে বলে ফেডারেশন। নিরাজবাদী ফেডারেশন অন্য কতৃত্ববাদী অথবা রাষ্ট্রবাদী ফেডারেশন থেকে অনেক ভিন্ন কেননা নিরাজবাদী ফেডারেশন তার ভেতরের ছোট সংগঠন গুলোর স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখে। নিরাজবাদী ফেডারেশনটি তার কতৃত্ব অথবা শাসন তার ভেতরের অন্যান্য ছোট সংগঠনের ওপর চাপিয়ে দেয় না। কেননা নিরাজবাদীরা এক হয় তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়নের আসায় একে অপরকে সহযোগীতার লক্ষ্যে, কাউকে শাসন অথবা কারো উপর কতৃত্ব চাপিয়ে দেয়ার জন্যে নয়।

একটি স্বাধীন ও শোষনমুক্ত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নিরাজবাদীদের সংগঠনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সময়ের দাবী। নিরাজবাদীরা তাদের সংগঠনগুলোতে এমনসব কার্যকর রীতি ও উপযূক্ত জ্ঞান বা যন্ত্র উপস্থাপন করতে পারবে যা নিরাজবাদী কর্মসূচিগুলোকে বাস্তবায়ন করতে পারবে। এই কার্যকর রীতিগুলো হতে পারে ফেডারেশন, ফেডারেশনের ফেডারেশন, কংগ্রেস, পত্র বিনিময় কমিটি এবং আরো অনেক কিছু। কিন্তু অবশ্যই এগুলো এমনভাবে করতে হবে যা সেই সংগঠনের কোন একক মেম্বার অথবা সেই সংগঠনের ভিতরের ছোট সংগঠনের চিন্তা এবং উদ্দ্যোগকে সীমাবদ্ধ না করে। নিরাজবাদী কংগ্রেস অথবা ফেডারেশন তাই কতৃত্ব বা রাষ্ট্রবাদী কংগ্রেস অথবা ফেডারেশনের মত সৈরাচারী হতে পারে না কেননা নিরাজবাদী কংগ্রেস অথবা ফেডারেশন কারো উপর কোন কিছু জোর পূর্বক চাপিয়ে দেয় না অর্থাৎ কোন আইন প্রণয়ন করে না।

অবশ্যই আমাদের সংগঠনের আয়ু এবং স্থায়িত্বতা আমাদের সংগ্রামের সাফল্যের মাপকাঠি। কিন্তু সকল মুক্তিবাদী বা নিরাজবাদী সংগঠনের উচিত তার স্থায়িত্বের লক্ষ্য ঠিক করা তার ব্যক্তির পারস্পরিক আধ্যাত্মিক প্রীতির উপর। সেই সংগঠনগুলোকে এই লক্ষ্য ও রাখতে হবে যেন তাদের সংবিধান অবিরাল পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির উপর খেয়াল রেখে খাপ খাওয়াতে পারে। এই সকল সংগঠনকে শ্রমিকেরা তাদের প্রয়োজনমত ব্যবহার করতে পারবে রাষ্ট্র এবং পূঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসেবে।

শ্রমিক শ্রেণি কখনই নিজেকে মুক্ত করতে পারবে না যতদিন তারা অর্থনৈতিক ও বাস্তবতার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ না হয়। এই ঐক্যের মাধ্যমেই তারা তাদের শাসকের সম্মিলিত শক্তিকে দমন করতে পারবে।

আমরা নিরাজবাদীরা আমাদের মত ও ধারণা প্রচারের জন্য শ্রমিকদের মাঝেই থাকব। আমাদেরকে তাদের সংগঠনগুলোর সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে, সেগুলো নিরাজবাদী হোক বা না হোক। কেননা আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন, এ সকল সংগঠনের বাইরে থেকে আমরা আমাদের মতবাদ প্রচারে বেশি সুফল হব না। শ্রমিকগণ একধাপেই নিরাজবাদী বা এনার্কিস্ট হতে পারবে না। শুধু নামেই নয়, একজন বিস্বস্ত নিরাজবাদী হতে হলে একজন শ্রমিককে তার শ্রমিক ভাই-বোনদের প্রতি সংঘতি অনুভব করতে হবে যাতে সে তাদের মুক্তির লড়াইয়ে যোগদান করতে পারে, একে অপরকে সাহায্য সহযোগীতার মাধ্যমে তাদের যৌথ স্বার্থ পূরণ করতে পারে, যার দ্বারা সে তার মনিব-সরদার এবং তাদের রক্ষা করে যে সংগঠন অর্থাৎ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সফল সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারে। এর মাধ্যমে তাদের বুঝে উঠতে হবে যে এই মনিব-সরদার বা পুঁজিপতি শ্রেণী ও সরকার হল অকার্যকর পরজীবী এবং শ্রমিকেরা নিজেরাই তাদের যৌথ সম্মিলনে স্বদেশী অর্থনীতি পরিচালনা করতে পারবে। যখনই একজন শ্রমিক এগুলো বুঝে উঠবে এবং মনে ধারণ করবে তখনি সে একজন সত্যিকারের নিরাজবাদী হবে।

আমরা নিরাজবাদীরা জানি যে একমাত্র শ্রমিক শ্রেণি বা জনগন নিজেরাই নিজেদেরকে মুক্ত করতে হবে। কেননা স্বাধীনতা কখনই কারও উপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া যায় না। স্বাধীনতা থেকে অর্জন করতে হয়। নিরাজবাদীরা শুধু তাদের দিক দেখিয়ে দিতে পারে ও নিরাজবাদ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে পারে যাতে তারাও মুক্তিবাদী বা নিরাজবাদী হতে পারে। কিন্তু মুক্তি সামনে এনে দেয়া অসম্ভব। আমরা নিরাজবাদীরা তাদের হাতে হাত রেখে মুক্তি ও সাম্যের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করব, তাদের সহদোর হিসেবে।

আমরা নিরাজবাদীরা বিদ্যমান সকল অত্যাচারী সংগঠনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দায়িত্ব নিয়েছি এবং নতুন এক সমাজ গঠনের প্রত্যয় করেছি যেখানে সকলের জন্য মুক্তি, স্বাধীনতা ও কল্যাণ নিশ্চিত থাকবে। এই লক্ষ্যে আমরা নিজেরাও সংগঠনে সংবদ্ধ হয়েছি এবং চাই যত দ্রুত সম্ভব সংখায় ঢের ও শক্তিতে অনমনীয় হতে।

Comments

Related content