এ কে এম শিহাব অনূদিত গ্রেগরী পেট্রোভিচ ম্যাক্সিমফ প্রণীত এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম পুস্তকের ধারাবাহিক প্রকাশ

Submitted by akmshihab on September 20, 2018

লেখক গ্রেগরী পেট্রোভিচ ম্যাক্সিমফ প্রসঙ্গেঃ

গ্রেগরী পেট্রোভিচ ম্যাক্সিমফ ১৮৯৩ সালের ১০ ই নভেম্বর রাশিয়ার নিভৃত পল্লীর মিটোশিনো প্রদেশের স্মলনেস্ক গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন । তিনি প্রথম জীবনে ধর্মীয় বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে প্রিস্ট হিসাবে স্বীকৃতি অর্জন করেন। তিনি অল্প দিনের মধ্যেই বুঝতে পারেন যে, এই পথ তার জন্য নয় তাই তিনি গীর্জা ছেড়ে সেন্ট পিটাসবোর্গে চলে আসেন। তিনি সেখানে ১৯১৫ সালে একজন কৃষি বিশারদ হিসাবে গভীর জ্ঞান অর্জন করে। তিনি তার ছাত্র জীবনেই বিপ্লবী হিসাবে নাম লিখান । তিনি ১৯১৭ সালের রাশিয়া বিপ্লবের একজন প্রথম সারির প্রচারক ও বিপ্লবী ছিলেন । পরে তিনি লাল ফৌজে ভর্তি হন । সেই সময়ে বলশেভিকগন এই ফৌজদের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেনীকে নিরস্ত্র করার জন্য অভিযান পরিচালনা করছিলেন । তিনি সেই কাজের বিরুধিতা করার অপরাধে মৃত্যু দন্ডে দন্ডিত হন। তবে তার প্রতি ইস্পাত শ্রমিকদের সংহতি ঘোষনা তাকে বাচিয়ে দেয় । তিনি এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট পত্রিকা গোলস ট্রাডা (ভয়েস অফ লেবার) এবং নভি গলোস ট্রাডা (নিউ ভয়েস অফ লেবার) সম্পাদনা করেন। ৪ ই মার্চ, ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ক্রোনস্টেড বিদ্রোহের সময় গ্রেপ্তার হন । তিনি ম্যাগনিতে টেগানাকা জেলখানায় অন্যান্য কমরেডদের সাথে আটক হন। চার মাস পর তিনি প্রায় তের দিনের জন্য অনশন ধর্মঘটে যান এবং ইউরোপীয় সিন্ডিক্যালিস্টদের হস্তক্ষেপের ফলে তিনি দশদিন পর অনশন ভঙ্গ করেন, পরে তিনি রেড ট্রেড ইউনিয়ন ইন্টারন্যাশনালের একটি কংগ্রেসে যোগদান করেন, তার প্রচেস্টার ফলে তার কমরেডদের বিদেশে নির্বাসিত হওয়ার সম্ভাবনা নিশ্চিত করে।

তিনি বার্লিন গিয়েছিলেন, যেখানে তিনি রবোটী রাখ (শ্রমজীবন) সম্পাদনা করেন, যা নির্বাসনে রাশিয়ান সিনডিক্যালদের একটি কাগজ। তিন বছর পর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্যারিস যান, যেখানে তিনি শিকাগোতে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে তিনি ১৬ মার্চ, ১৯৫০ তারিখে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত গলস ট্রুজেনসিকা (ওয়ার্কার্স ভয়েস) এবং পরে ডেইলো ট্রুডো-প্রুভঝেনি (শ্রমজীবন - জাগরণ) সম্পাদনা করেন।

ম্যাক্সিমোফ তার জীবনের পূর্নতার আগেই হ্রদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরন করেন। তার মৃত্যুতে চারি পাশে শোকের ছায়া নেমে আসে। তিনি কেবল একজন সৃজনশীল চিন্তক ছিলেন না, তিনি অত্যন্ত দৃঢ় চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। তিনি অনেক বড় মাপের মানবিকতার অধিকারী ছিলেন । তিনি একজন সামগ্রীক চিন্তার অধিকারী লোক ছিলেন । তার চিন্তায় হতাশার আধার কাটিয়ে আলোর জ্বলক ফোটানোর প্রায় ছিলো খুব স্পষ্ট । তিনি নিজেকে একজন এনার্কিস্ট হিসাবে এই জন্য গড়ে তুলেন নাই যে এটা তার উপর কোন দায়িত্ব, বা বাহির থেকে কেউ তা চাপিয়ে দিয়েছে তার উপর। এই চেতনা তার হ্রদয়ের চেতনা ছিলো। যা তার কর্ম ও চিন্তাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে ছিলো । যা দ্বারা তিনি সারাজীবন চালিত হয়েছেন ।

- রুডলফ রকার

ভূমিকাঃ এনার্কিজমের আলোকে আধুনিক সমাজ

প্রচলিত সমাজ হল পুঁজিবাদী সমাজ। এই সমাজের ভিত্তি হলো ব্যাক্তিগত সম্পত্তি। এই সমাজের প্রধান চরিত্র হলো উৎপাদন করা হবে বানিজ্যের জন্য, মুনাফার জন্য । উৎপাদন সম্পর্ক ও গড়ে উঠে এরই উপর ভিত্তিকরে, সকল পন্য বিতরন করা হয় বা মালিকানা গ্রহন করা হয় ব্যাপক সংখ্যায় শ্রমিকের মজুরী সহ স্বল্প সংখ্যক লোকের জন্য – পুঁজিবাদী শ্রেনীর স্বার্থে। বিপুল পরিমান মানুষ কেবল শ্রম শক্তির বাহন হয়ে থাকে- শারিরিক ও মানসিক বা মেধাগত শ্রম পুঁজিবাদীদের নিকট বিক্রি করে দেয়া হয় ; শুধু তাই নয় প্রলেতারিয়েত, দরিদ্র কৃষক, মধ্যবিত্ত, ক্ষুদ্র শিল্পের উৎপাদন যা নিজেরা উৎপাদন করেন, তারা সকলেই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ্য ভাবে পুঁজিবাদের নিকট বন্দ্বী। পুঁজির নিকট দায়বদ্ব হয়ে আছেন ।

আধুনিক সমাজের এই পদ্ধতির কারণে, অবিচ্ছিন্ন সম্পদ এক প্রান্তে সঞ্চিত হয়, অন্যদিকে ভয়াবহ দারিদ্র্য রয়েছে। উন্নত পুঁজিবাদের দেশগুলিতে এই বিষয়টি বিশেষভাবে স্পষ্ট হয়, যেখানে সমাজের শ্রেণিবিভাগটি অত্যন্ত স্পষ্ট ও তাত্পর্যপূর্ণ। “ কেহ কেহ বলেন, সত্যিকার ভাবে বেশী সম্পত্তির মালিক ও কম সম্পত্তির মালিকদের মধ্যে ভেদ রেখা টেনে দেয়া সত্যি কঠিন কাজ । যেহেতু এই সমাজ গুলো একে অপরের সাথে নানা ভাবে পারস্পরিক ভাবে সম্পর্কিত হয়ে আছে । তাদের মধ্যে স্পস্ট ভাবে তেমন কোন ভেদ রেখা দৃশ্যমান নয়। যদিও প্রানী জগত ও বৃক্ষ জগতের মাঝে একটি স্পস্ট ভেদ রেখা আছে, হিংস্র প্রানী জগত ও মানুষের মাঝে খুব সহজেই পার্থক্য নিরূপন করা যায় ।

মানব সমাজে সাম্য নির্ভর করে পরিস্থিতির উপর, যদি ও অনেক ক্ষেত্রে অনেক তথ্য উপাত্ত মজুদ নেই, তবে এটা বলা যায় যে, সামাজিক পরিবর্তন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বদল হলে অজান্তেই অনেক কিছু পাল্টে যায়। সামাজিক শ্রেনী বিভক্তি অনেকটা স্পস্ট । প্রায় সকলেই বলতে পারেন সমাজে কারা উচ্চ বিত্ত, মধ্য বিত্ত আর কারা নিম্ন বিত্ত বা প্রলেতারিয়েত। এটা দিবালোকের মতই স্পষ্ট যে কে কে অনেক জমির মালিক, কাদের নিয়ন্ত্রনে অনেক বেশী মজুর আছে । যারা কৃষি শ্রমিক হিসাবে গ্রামীন পরিবেশে কাজ করে জীবন জীবিকা নির্বাহ করেন” ( এম এ বাকুনিন)। আধুনিক সমাজে রাষ্ট্র তার সকল শক্তি দিয়ে যেমন তার লোকদের চালনা করে তেমনি গ্রামীন সমাজে ধর্ম ভিত্তিক নৈতিকতার আবরনে তাদেরকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রন করা হয় ।

পুঁজিবাদী সমাজের সকল কিছুই নির্ভর করে পন্য কেনা বেচার উপর- বাজারের বৈশিস্ট হলো এটা বিতরনের মাধ্যম যে সকল পন্য ব্যবহার উপযোগী করা হব, তা এই প্রক্রিয়ায় বিতরন করা হবে । আর সেই কারনেই একটি পুঁজিবাদী সমাজে সকল কিছুই পন্য হিসাবে পরিগনিত হয়ে থাকে । ( তা কেবল বস্তুগত জিনিষ নয়, বিজ্ঞান, শিল্প, এমন কি নৈতিক গুণাবলী ও বিক্রয় যোগ্য।) ফলে, উৎপাদন অংশ ক্ষুধা দারিদ্র আর মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়। কেননা সেই মানুষ গুলো ও পণ্যে পরিণত হয়ে পড়েন । সেই সমাজের মধ্যে মানুষের ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, চিন্তা ভাবনা, শারীরিক প্রয়োজোন সকল কিছুই পন্য হিসাবে গন্য হয় ।

পুঁজিবাদী ধনিক শ্রেনী ও তাদের সম্পদের সুরক্ষা দেয় রাষ্ট্র; ফলে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় শ্রমিক শ্রেনী যখন কাজের জন্য মালিক পক্ষের সাথে কোন চুক্তিতে আবদ্ব হয় তখন রাষ্ট্র শ্রমিক নয় মালিক পক্ষের স্বার্থে কাজ করে থাকে। সামাজিক এই নীতিমালায় সাধারন ধরে নেয়া হয় সাম্য ও ন্যায্যতা বজায় রাখা হবে, কিন্ত বাস্তবতা হলো সকল সময়েই সুবিধাবাদি শ্রেনীর পক্ষে সকল কিছু হয়ে থাকে। এমন কি শ্রমিক বা প্রলেতারিয়েতগন প্রতিবাদ করলে তাদের বিরুদ্বে রাষ্ট্র শক্তি প্রয়োগ করে থাকে । প্রচলিত ব্যবস্থায় দূর্বলদের জন্য কোন জায়গা নেই, এখানে শক্তিমানদেরই পুজা করা হয় । এই প্রচলিত পরিস্থিতিতে পুঁজিবাদী শ্রেনী বেশ কিছু সুবিধা আদায় করে নেবার সুযোগ পায়, রাস্ট্রীয় সুবিধার পাশা পাশি শ্রমিকদের শ্রমে উৎপাদিত পন্যের সিংহ ভাগ মালিক পক্ষ তাদের পকেটস্থ করে নেয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভেতর শ্রমিক শ্রেনী মধ্যস্থতা করার পরিধি ও সীমিত। প্রায়স রাষ্ট্র মালিকদের পক্ষ নিয়ে শ্রমিকদেরকে নির্মম ভাবে দমন করার কাজ খুবই বিশ্বস্থতার সাথে করে থাকে।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এখন পর্যন্ত যে উন্নয়ন হয়েছে তা সামগ্রীক ভাবে মালিক পক্ষ ব্যবহার করতে চায় না, বরং খুবই সীমিত আকারে উচু স্তরে বিশেষ করে শোষক শ্রেনীর লোকেরা এই সকল প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে । আজো মেহেনতী মানুষ প্রযুক্তির সুফল ভোগ করার সুযোগ পায় নাই । যাদের শ্রমে ঘামে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক বিকাশ হয়েছে তার সুফল চুড়ান্ত বিশ্লেষণে পুঁজিবাদী শ্রেনীর ঘরে চলে যাচ্ছে । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে ক্রমবর্ধমান উন্নয়ন হচ্ছে তা কাজে লাগাতে পারলে উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরও সহজতর করা সম্ভব হবে । প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লে উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় বড় শিল্পের বিকাশ হবে । ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প গুলো নিজেদের পুঁজি সহ নানা কারনে সংকুচিত হয়ে পড়বে। এরা বড় শিল্পের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরবে । ফলে শ্রমিক সংখ্যা বৃদ্বি পাবে ।

অধিকন্তু, ক্রমবর্ধমান হারে যান্ত্রিকিকরনের ফলে পন্য উতপাদনের হারে দ্রুত বৃদ্বি পায়, ফলে উদ্যোক্তাদের মাঝে শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দেয়। তখন রাস্ট্রীয় ক্ষমতার চত্রছায়ায় মালিক পক্ষ অপেক্ষাকৃত দূর্বল জনশক্তি যেমন- নারী ও শিশুদেরকে কাজে লাগিয়ে দেয়। সেই কারনে ক্রমবর্ধমান যান্ত্রিকিকরনের ফলে বেকারত্ব বেড়ে যায়, পুঁজিবাদীরা ভাড়াটে শ্রমিক কাজে লাগায়, মজুরী কমিয়ে দেয় আর সমাজে বাড়ায় তিব্র শোষণ ও দারিদ্রতা।
আধুনিক সময়ে যান্ত্রিকতার যে বিকাশ হয়েছে তাতে মানুষ নিজের শক্তি ও সময় ব্যবহার করতে পারছে, অর্থনীতিতে সঞ্চার করতে পারছে বিপুল অগ্রগতি, উৎপাদন করতে পারছেন বিপুল পরিমানে পন্য সামগ্রী যা মানুষের চাহিদা মাটানোর জন্য সরবরাহ করা হচ্ছে নানা ভাবে । কিন্তু এখনো পুঁজিবাদ সকলের চাহিদা মেটাতে পারছে না । এখোনো অগনিত মানুষ শিল্প পন্যের নাগালের বাইরে রয়ে গেছেন। তা ছাড়া পুঁজিবাদের নিজস্ব দূর্বলতার কারনেই সকল মানুষের সমান ভাবে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয় । এমন কি মানুষের নিত্য প্রয়জনীয় পন্য যেমন খাদ্য, কাপড়, গৃহ এবং শিক্ষার মত জিনিষ ও সকলকে দেয়া পুঁজিবাদের পক্ষে অসম্ভব । প্রচুর মানুষ আছেন যারা তাদের পছন্দ সই কাজ খোজে পাচ্ছেন না, বেকারত্ব, অর্ধ বেকারত্ব মানুষের পেছনে লেগেই আছে ।

প্রচলিত ব্যবস্থায় পুঁজিবাদী দেশ সমূহে মানুষের অগনিত মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাচ্ছে । ফলে উৎপাদিত পন্য ধ্বংস করা ও এক সমস্যা হিসাবে দেখা দিয়েছে । দেশের ভেতরে স্তুপিকৃত পন্য ধবংস করতে না পেরে আন্তর্জাতিক বাজারে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। অথচ এমন অনেক পন্য আছে যা অনেক দেশের জন্যই উপযোগী নয় । ফলে অর্থনীতিতে দেখা দেয় সংকট, মন্দ্বা, ও দেওলিয়াত্ব ইত্যাদি। অনেক উদ্যোক্তার কর্ম ক্ষেত্র বিনাশ হয়ে যায় । নিচে নেমে যায় কর্মজীবী মানুষের জীবন যাত্রার মান ।

উতপাদনে বিশৃঙ্খলা এবং বাজারে দেখা দেয় সীমাহীন প্রতিযোগীতা ফলে বড় পুঁজির অধিকারী সংস্থা গুলো একচাটিয়া ভাবে সুবিধা আদায় করে নেয় – তারা তখন নিজেদের মধ্যে গড়ে তোলে সিন্ডিক্যাট, কার্টেলস ও ট্রাষ্ট । যা আমরা বিংশ শতাব্দীতে অনেক উদাহরন দেখেছি । যারা অর্থনীতি ও রাজনীতিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব বলয় তৈরী করে শিল্পোন্নত দেশ সমূহে ব্যাপক সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। সেই পথ ধরেই পুঁজিবাদী দেশ সমূহ নিজেদের শিল্পের বিকাশ ও পুঁজির পরিমান ব্যাপক ভাবে বাড়িয়ে নিয়েছে। এই পরিস্থিতির কারনে বিবর্তনের ইতিহাসে নয়া অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে – পুঁজিবাদের অধ্যায় বিকশিত হয়েছে এবং যাকে আমরা পুঁজিবাদের চূড়ান্ত উন্নয়ন মনে করি ।

পুঁজিবাদ বর্তমান দুনিয়ায় এখন একটি সাম্রাজ্যবাদি স্তরে উন্নিত হয়েছে এবং এটার অর্থনৈতিক অবস্থাটি এখন একটি কম্যান্ডে পরিনত হয়েছে । পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আর নতুন কিছু দেবার নেই এখন এর বিদায় নেবার সময় হয়েছে । এটা এখন যতদিন ঠিকে থাকবে তা মানুষকে কস্ট ছাড়া আর কিছুই দিতে পারবে না । সুনির্দিস্ট ভাবে বললে বলতে হয়, সাম্রাজ্যবাদ এখন দুনিয়ার সকল জায়গা থেকে সকল সম্পদ নিজের দেশে পুঞ্জীভূত করার জন্য যা যা করনীয় তার সবই করবে । যুদ্ব, খুন ও গুম সব । দুনিয়ায় তাদের কথাই চলবে। অন্যদের কথা কেবলই কথার কথা ছাড়া আর কিছুই নয় । তা কেবল অর্থনৈতিক বিষয়ে নতুন রাজনৈতিক এমন কি সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ও তাদের ইচ্ছাই শেষ কথা । সকল জাতি সকল দেশ তাদের কথা বাহিরে যাবার কোন সাধ্য নেই ।

অন্যান্য দেশে ব্যাপক ভিত্তিক বিনিয়োগ করার পেছনে সাম্রাজ্যবাদি দেশ গুলোর নজর থাকে সংশ্লিষ্ট দেশ সমূহের প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানব শ্রম শোষণ করার দিকে । তারা সত্যিকার ভাবেই “পিতৃভূমির” ধারনাটিকে কুসংস্কার হিসাবেই বিবেচনা করে থাকে। তাদের নিকট মুনাফাই হলো আসল কথা । নিজেরা জাতীয়তাবাদের কথা বললে ও আদতে এরা শোষক হিসাব আন্তর্জাতিক ধ্যান ধারনার উপাসক ।

পুঁজি কখনো “পিতৃভূমি” চিনে না । আমরা দেখতে পাচ্ছি বড় বড় ট্রাষ্ট সমূহ রাস্ট্রীয় আইনের আওতায় আবদ্ব। সকল সংস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আসলে অভিন্ন। তাদের লক্ষ্য দুনিয়ার উপর প্রভূত্ব কায়েম করা । তাদের মধ্যে ও সেই জন্য পারস্পরিক প্রতিযগীতা বিদ্যমান আছে । আর সেই জন্যই পুঁজিবাদী সমিতি সমূহ বাজারের দখল নেবার জন্য মরিয়া হয়ে প্রচেস্টায় লিপ্ত রয়েছে । বিভিন্ন দেশের এই মরিয়া চেস্টার ফল হিসাবে কোন কোন সময় আমরা “সশস্ত্র শান্তি”র মহড়া দেখতে পাই, তবে প্রায়স তা যুদ্বে রূপ নেয় । ১৯১৪-১৯১৮ সালে এই রকমের একটি লড়াই আমরা দেখেছি । সাম্রাজ্যবাদি যুদ্ব দুনিয়াকে অসাম্য করে তোলে, বিজয়ী ও বিজেতা হিসাবে যেমন বিভক্তি রেখা টেনে দেয় তেমনি প্রলেতারিয়েত ও দরিদ্র কৃষকদের জন্য জীবন দুর্বিসহ করে তোলে । সাম্রাজ্যবাদ হলো সকল যুদ্বের উৎস। এটা স্পষ্ট করেই বলে দেয়া যায় যে, যতদিন পুঁজিবাদ থাকবে ততদিন যুদ্ব ও দুনিয়াময় বিরাজমান থাকবে ।

সাম্রাজ্যবাদের বিকাশ মানেই হলো বেকারত্বকে স্থায়ীত্ব প্রদান করা, এটা মানুষের বিশ্বাস নিয়ে খেলা করে, ধর্মকে কাজে লাগায় রাষ্ট্র, আইন ব্যবহার করে মানুষকে বিকশিত হতে বাঁধা প্রদান করে । এটা প্রলেতারিয়েতের আন্দোলন সংগ্রামকে কঠিন করে দেয় এমনকি তাকে দমনে নানা প্রকার ব্যবস্থা গ্রহন করে থাকে । যদি ও সমাজের কিছু অংশে শ্রেনী চেতনা বৃদ্বি পায়, শোষণ সম্পর্কে মানুষ সচেতন হয়, প্রতিবাদ প্রতিরোধের দাবী তিব্রতর হয় । তবে এটা ও স্পস্ট হয় যে প্রচলিত সংগঠন সমূহের বদলে নয়া সংস্থা গড়ে তুলা ছাড়া এই পরিস্থিতির বদল করা সম্ভব নয় ।

ইতিহাসের মহান উদ্যোগ যা রাশিয়ার সমাজ ব্যবস্থাকে পাল্টে দিয়েছিলো ১৯১৭- ১৯২১ সালে মধ্য ইউরূপের কয়েকটি দেশকে প্রচন্ড ঝাকুনি ও দিয়েছিলো, সেই ঝাকুনির পেছনে ও পুঁজিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী যুদ্বই ছিলো প্রধান নিয়ামক । রাশিয়া ও জার্মানীর বিপ্লবের জন্য কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত বিবচনায় ছিলো না; কিন্তু রাশিয়ার বিপ্লবটি রাস্ট্রবাদি সমাজবাদের খপ্পরে পড়ে যায়। ফলে রাস্ট্রীয় সমাজবাদ আর পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখা যায়নি। যেখানে উভয়ই রহস্য জনক পদ্বতী অনুসরন করে সকল সমস্যার সমাধানের প্রায়স চালায়; তারা চেষ্টা করেন ক্ষমতা ও সংহতি, সমতা ও শোষণ, প্রগতি ও দারিদ্রতার মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে । যা আদতে অসম্ভব ব্যাপার । কেননা এই গুলো পরস্পরের সম্পূর্ন বিপরীত বিষয়। এই গুলো কোন গুনগত বা পরিমান গত উপাদান নয় যা একে অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে। রাশিয়ান বিপ্লবে প্রচলিত রাস্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্যার সমাধানের জন্য কঠোর ও কট্টর সাম্যবাদি পন্থা অনুসরন করা হয়েছিলো। আসল বিষয় হলো সাম্যবাদ কৃতৃত্ববাদি ভাবধারা দিয়ে বাস্তবায়ন করা যায় না । তা করা হলে সামাজিক ভাবে নানা ক্ষেত্রে সমস্যার সৃষ্টি করবেই । তার জন্য দরকার সামাজিক শক্তির বিকাশের সাথে সাথে সকলের স্বেচ্ছাকৃত অংশগ্রহন নিশ্চিত করা । যা ছিল রাসিয়ান বিপ্লবে একেবাই অনুপস্থিত।

রাশিয়ায় ক্ষমতা ভিত্তিক সাম্যবাদের চর্চা আমাদেরকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, আমরা পদ্বতীর বাস্তবসম্মত জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছি । রাষ্ট্র ভিত্তিক সাম্যবাদি চর্চায় পন্যের উৎপাদন ও বিতরন প্রক্রিয়ায় আমলতন্ত্র এক অন্দ্ব ভুতের মত জনগণের উপর চেপে বসে । সেই প্রাশাসনিক ব্যবস্থায় সকল প্রকার উৎপাদন যন্ত্র, সরবরাহ করার পন্য, সকল শ্রমিকের শ্রম, এবং একজন ব্যাক্তি নিজে ও রাস্ট্রের মালিকানায় চলে যায়, যা প্রকারান্তরে স্বল্প সংখ্যক মানুষের ক্রিড়নকে পরিনত হয়। সমাজের সকল স্তরের মানুষ যারা শ্রম দিয়ে নানা প্রকার পন্য উৎপাদন করেন তারা সেই ব্যবস্থায় শুধুই রাস্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্বির কাজ করে থাকে। ফলে যারা প্রশাসনে থাকে তাদের ও ক্ষমতা বাড়তে থাকে । যা অনেক ক্ষেত্রে আবার জনগণকেই নানা ভাবে নিপিড়নের শিকার হতে হয় ।

আমলাতন্ত্রের জাল শিল্প সম্পর্ককে এবং অর্থনৈতিক জীবন ও সমাজকে ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে, এরা সকল প্রকার জনশক্তিকে রাস্ট্রের জন্য কাজ করতে বাধ্য করে থাকে, জনগনকে নানা বিভক্ত করে, সামাজিক স্তরবিন্যাস তৈরী করে, জনগণকে অফিসিয়াল নিয়ন্ত্রনে চালিত করে আমলাতন্ত্রের প্রভাব বলয় বজায় রাখে। জনগনের ব্যাক্তিগত পরিচয়ের বিপরীতে তাদেরকে “জনশক্তি” নামে অবহিত করে থাকে। রাষ্ট্র যেমন পরিকল্পনা করে সে তার ইচ্ছেমত জনশক্তিকে ব্যবহার করে থাকে। সেই ক্ষেত্রে সাধারন মানুষের আশা আকাংখার চেয়ে রাস্ট্রীয় আমলাদের স্বার্থই প্রাধান্য পেয়ে থাকে । এই প্রক্রিয়া যদি কোন সাম্যবাদি সমাজে ও অনুসরন করা হয় তবে মানুষ এক প্রানহীন রোবটে পরিনত হয় । মানুষ রাস্ট্রের দৃষ্টি ভঙ্গীর বাইরে কিছু ভাবতেই পারে না । ফলে ব্যাক্তি হিসাবে মানুষের সৃজনশীলতার মৃত্যু ঘটে। সামাজিক স্তর বিন্যাস আরও শক্তিশালী হয়। নিশ্চিত ও নিরাপদ হয় আমলাদের রাজত্ব।

নাগরিক সমাজের জীবন একটি পুলিশ রাস্ট্রের সত্যিকার অর্থে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যেতে পারে না। ক্ষমতার কেন্দ্রীকতার কারনে একটি সাম্যবাদি রাস্ট্রে ও সাধারন মানুষ রসকষ হীন ভাবে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। মানুষকে পদে পদে পর্যবেক্ষনের শিকার হতে হয় । এই পদ্বতী মানুষের স্বাধীনতাকে কবর দিয়ে দেয়। সমাবেশ করা, মুক্তভাবে কথা বলা, সংবাদ আদান প্রদান করা, শিল্প সংগ্রাম জোরদার করা, ও ব্যাক্তি হিসাবে নিজের উন্নয়ন সাধন কোন ভাবেই সম্ভব হয় না । এই সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়া মানুষের ব্যাক্তিগত সম্পর্ককে পর্যন্ত বিনষ্ট করে ফেলে । নাগরিক জীবন হয়ে উঠে দুর্বিসহ।

এই ধরনের সামাজিক বিবর্তন পুঁজিবাদের অধীনে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারনে অধিকতর তিব্রতর হবে, শ্রেনী সংগ্রাম হবে আগের যেকোন সময়ের তুলনায় নির্মম ও নিস্টুর প্রকৃতির। রাশিয়ার সমাজ ব্যবস্থায় আমরা যে অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছি, তাতে বুঝা যাচ্ছে সামাজিক এই কাঠামোতে প্রচুর অসামঞ্জস্য বিদ্যমান ছিলো। এই সমাজ কাঠামোটি পরিগঠনের পেছনে স্বাধীন সাম্যবাদের বদলে কৃতৃত্ববাদি সাম্যবাদ অনুসরন করা হয়েছিলো । এই বিষয়টি স্পষ্ট হয় যখন আমরা পুঁজিবাদী পুলিশি ব্যবস্থার রীতিনীতি গুলো অধ্যয়ন করি। বলশেভিক চক্র নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য বিকল্প পথ হিসাবে রাস্ট্রবাদি ধারনার অনুসরন ও অনুকরন কঠোর ভাবে করতে থাকে ।

রাশিয়ার বিপ্লব শুরু হয়েছিলো ধনিক শ্রেনীর সমাজকে চুরমার করে দিয়ে একটি স্বাধীন ও মুক্ত সমাজ গড়ে তুলার জন্য, কিন্তু একটি অভিজাত চক্র একনায়কতান্ত্রিকতার আমদানি করে বসে, তারা ফিরে যায় “ ওয়ার কমিউনিজম” এর পথে। যা আদতে পুজিবাদেরই নামান্তর । তবে, এই বিপ্লব ফ্র্যান্স বিপ্লবের মত একটি মহান ধারনা দুনিয়ার সামনে মানুষের হাজির করেছে, মানুষকে প্রেরনা দিয়েছে পুরাতন ধ্যান ধারনা থেকে বেড়িয়ে আসার জন্য। এই বিপ্লবের আসল লক্ষ্য ছিলো দুনিয়ার সকল দেশের, জাতির ও বর্নের শ্রমিকদেরকে আন্দোলন সংগ্রামে প্রেরনা সৃষ্টি করে দিতে ।

কেবল মাত্র এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্ট বিপ্লব ই প্রলেতারিয়েত এবং সমগ্র মানব সমাজকে সত্যিকার স্বাধীকারের দিকে নিয়ে যেতে পারে, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ সৃজন করতে পারে সামাজিক জীবনে । এই মতবাদই কেবল মানুষকে নিরাপদ করতে পারে সকল যুদ্ব, সন্ত্রাস থেকে, এমন কি যে সকল রাষ্ট্র সাম্যবাদের নামে শাসনের নামে নানা ভাবে মানুষকে নিপিড়ন করছে। রাশিয়ার সাম্যবাদের দেউলিয়াত্ব, জার্মানীর সামাজিক গণতন্ত্রের প্রহেলিকা, ও পুঁজিবাদের সামাজিক দ্বান্দ্বিকতা এবং প্রচলিত সমাজে শ্রমজীবী মানুষের লড়াই সংগ্রামের একটি সুস্টু সুরাহা করতে পারে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম।
কেবল মাত্র সামাজিক বিপ্লবই ব্যাক্তিগত সম্পত্তির বিনাশ করতে পারে, আর চিরতরে বিলিন করতে পারে এর ভিত্তি রাষ্ট্র যন্ত্রকে। প্রতিস্টা করতে পারে সামাজিক মালিকানা, রাস্ট্রবিহীন ফেডারেশন ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা। যার মৌল কাঠামোটি তৈরী হবে স্বাধীন ও মুক্ত চুক্তির মাধ্যমে কারখানা ও গ্রামীন উন্নয়ন শাখা প্রশাখার। এটাই নিশ্চিত করে দিবে সামগ্রীক স্বাধীনতার। তা সামজের মানুষের ব্যাক্তিগত স্বাধীকার, উন্নয়ন, এবং মানব সমাজের উপর থেকে বিতারিত করবে সকল প্রকার প্রভূত্বের । সেই সমাজে কোন ভাবেই মানুষের উপর মানুষ প্রভূত্ব করতে পারবে না ।

রাশিয়ার অভিজ্ঞতা আমাদেরকে শিক্ষা দেয় যে, সাম্প্রদায়িক সামাজিক চক্র দূর করতে হলে অবশ্যই এনার্কিস্ট সাম্যবাদ অনুসরন করতে হবে। রাস্ট্রবাদি পুঁজিবাদের বিতারনের জন্য সামগ্রীক ভাবে এনার্কিস্ট সাম্যবাদ চর্চা করতে হবে। এটা কেবল প্রলেতারিয়েত শ্রেনীকে প্রতিবিপ্লব প্রতিরোধে সহযোগিতা করবে না, বরং সমাজের পরগাছে ও পরজীবীদেরকে সমূলে বিনাশ করতে সাহায্য করবে। এছাড়া সামাজিক পর্যায়ে নানা বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য “প্রলেতারিয়েতের একানায়কত্ব” কায়েমের ও দরকার হবে না ।

এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে কিছু অবস্থার মুখোমুখী হতে হয়, সেই প্রসঙ্গে লিটাকুনিন বলেছেন, “ জমির মালিকানা পাবে তারাই যারা নিজেদের হাতে জমিতে ফসল ফলান, যাকে বলা হয় কৃষি যৌথ খামার। পুঁজি ও কারখানার মালিকানা চলে যাবে শ্রমিকদের নিকট । যাকে বলা হয় শ্রমিক ইউনিয়ন”। একেই সময়ে, “ সকল রাজনৈতিক দল মুক্ত স্বাধীন ফেডারেশনের আওতায় চলে আসবে, এই গুলো কৃষি ও শিল্পের আওতায় নিজেদের জায়গা করে নিবে”। যাকে বলা হয়, রাজনৈতিক সামাজিকি করন, বা মুক্ত গ্রামে মুক্ত ফেডারেশন; অর্থনীতিতে প্রতিস্টিত হবে সিন্ডিক্যালিজম । সাম্যবাদি সংগঠনের মাধ্যমে স্বাধীন মুক্ত কারখানায় স্থাপিত হবে । এই প্রক্রিয়ায় সকল গ্রাম ও কারখানা সকলেই একত্রিত হবে এবং উৎপাদনে তৎপর হবে। জনগণের চাহিদার আলোকে উৎপাদন অব্যাহত রাখবে ।

“ গ্রাম ও কারখানা” বাকুনিন প্রস্তাব করেছেন, “ সব কিছু নিচের দিক থেকে পুনঃ গঠনন করা হবে, প্রথমেই কিছু নতুন ভাবে স্থাপন বা গঠন করা হবে না – প্রতিটি সংস্থা ও প্রতিস্টানকে যথাযথ ভাবে সংস্কার ও পুনঃগঠন করা হবে । তবে, প্রতিটি সংস্থাই হবে প্রানবন্ত। সেই গুলো এখন যেমন আছে তার ছেয়ে শত গুন ভালো সেবা প্রাদন ও উৎপাদনে ভূমিকা রাখতে পারবে । সেই নয়া সংগঠন গুলো নিজেদের সাধ্যমত প্রচারনায় অংশ গ্রহন করবে। তাদের উপর কোন রাষ্ট্রীয় খবরদারী থাকবে না। তারা নিজেদের মত করে প্রচারনা চালাতে পারবে, নিজেদের বিকাশ সাধনে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারবে। যতক্ষন পর্যন্ত নিজেদেরকে একটি দক্ষতাগত উন্নত স্তরে পৌঁছাতে না পারবে ততক্ষন পর্যন্ত ব্যবস্থাপনাগত প্রশিক্ষন অব্যাহত থাকবে”।
শ্রমিক শ্রেনীর লকেরা স্বাধীকার অর্জনের মহান লক্ষ্য ও দুনিয়াকে হেফাজত করার জন্য কাজ করবে। আন্তর্জাতিক এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের কাজই হলো বিপ্লবের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা। মানব জাতির ইতিহাসে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানে - ইতিহাসের অনিবার্য দাবী পুরনের জন্য এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম সক্রিয় ভাবে কাজ করে যাবে। প্রলেতারিয়েতের মুক্তি নিশ্চিত করবে। শ্রেনী সংগ্রামের ফলাফল সকল মানুষের জন্য নিবেদন করবে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম । আজ সেই মহান কাজটি সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে। অত্র পুস্তকে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের বিপ্লবের অন্তর্বতী কালিন সময়ে করনীয় সহ নানা দিক তোলে ধারার প্রায়স থাকবে। তবে বাস্তব উদাহরন হিসাবে রাশিয়ায় বিপ্লবী পরবর্তী সমাজকে ব্যবহার করা হবে।

প্রথম ভাগ- অর্থনীতি

প্রথম অধ্যায়ঃ উৎপাদন শিল্প

সাম্রাজ্যবাদী লড়াই সংগ্রামে এটা প্রমানিত হয়ে গেছে যে, রাশিয়ায় একটি অসফল বিপ্লব হওয়া সত্বে ও পুঁজিবাদী সমাজকে তাত্ত্বিক ভাবে যত বেশী শক্তিশালী মনে করে হয়েছিলো বাস্তবে তা নয়।
রাশিয়ার বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে আরও একটি জিনস তোলে ধরেছে যে, সামাজিক বিপ্লবে মানুষের চাহিদার মাত্রা বৃদ্বি পায়, তবে সেই সময়ে উৎপাদনের পরিমান কমে যায়; এটায় আরও স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশ যখন বিপ্লবের পতাকা উর্ধে তোলে ধরে তখন বুর্জয়ারা বিপ্লবের বিপরীতে আক্রমনাত্মক হয়ে উঠে।
এই পরিস্থিতিতে অবর্ননীয় দুর্ভিক্ষ ও অনাহার দেখা দেয়। ফলে বাস্তব অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য পূর্ব প্রস্তুতী থাকা একান্ত আবশ্যক। যদি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার মত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেই প্রস্তুতিতে কে কোথায় কি কি দায়িত্ব পালন করবেন তা সুনির্দিস্ট ভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। প্রধানত কি কি উৎপাদন করতে হবে, কি ভাবে তা সুরক্ষিত হব, তার জন্য পূর্নাংগ পরিকল্পনা থাকা চাই । ( বিপ্লবের জন্য সামগ্রীক প্রস্তুতি অত্যাবশ্যক)।

রাশিয়ান বিপ্লবের অভিজ্ঞতা বলে সেই সময়ে বাধ্যতামূলক উৎপাদনের জন্য মানুষের উপর চাপ প্রয়োগ করা ছিল অত্যান্ত ক্ষতিকারন ও বিপদজনক পদক্ষেপ; এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম এই ধরনের বাধ্যতামূলক ভাবে কারখানা পরিচালনা, শ্রমিকদের স্পেশাল বাহিনী বা অন্য কোন প্রকারের সংস্থান করার চরম বিরুধী। সিন্ডিক্যালিস্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় শ্রমিকদের স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেয়াই আসল উদ্দেশ্য । অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ তার কাজের বিষয়ে পূর্ন স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। মানুষ তার পছন্দ মত কাজ বাঁচাই করে গ্রহন ও পরিবর্তন করতে পারবে।

সামাজিক বিপ্লবের ফলে নতুন সমাজ, তার অস্তিত্বের প্রথম দিন থেকেই শ্রমের একীকরণ নিশ্চিত করার উপায়গুলি কি কি তা খুঁজতে হবে, যাতে এককথায় চেতনাগত এবং শারীরিকভাবে উভয়কেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে । পুঁজিবাদী সমাজে শিল্প ও কৃষি শ্রমিকের মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদাতা অবস্থান দেখা যায়, কিন্তু সিন্ডিকেটবাদী সমাজ দৃঢ়ভাবে শিল্প ও কৃষির সম্পকর্কের মধ্যে আরও ঘনিষ্ঠতা অর্জনের প্রচেষ্টা চালাবে এবং যার ফলে শ্রমিকরা কারখানা এবং জমিতে বিকল্প কাজে যোগদান করতে সক্ষম হবে।

রাশিয়ার শিল্প প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতাটি দেখিয়েছে যে উৎপাদন কেন্দ্রিকীকরণের নীতিটি সমগ্র শিল্প যন্ত্রপাতির নীতিমালা, যা একটি সরকারী শ্রেণির উদ্ভবের দিকে পরিচালিত করে, উৎপাদকদের কাছ থেকে / সামাজিক অর্থনীতির প্রশাসনকে অপসারণ করার জন্য, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে চলমান সংকটের দিকে শ্রমিকদের স্বাধীন কার্যকলাপের বিরোধীতা করে এবং এই অভিজ্ঞতার কারণে, এনার্কো-সিন্ডিক্যালস্টিগন কারিগরি কেন্দ্রীকরণ এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের ভিত্তিতে উৎপাদন প্রক্রিয়া নির্মাণ করবে।

এই ভাবে রাশিয়ার বিপ্লব আমাদেরকে নিজেদের ত্রুটিগুলি সংশোধন করে প্রাপ্ত সমস্যার সামাধান করে সামগ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থায় একটি হ্রদয়তাপূর্ন পরিবেশ আনয়নের জন্য পরিবেশ তৈরী করে দিবে- এটা ছিলো প্রত্যাশা। এই অভিজ্ঞতা আমাদের সামনে প্রমানিত হয়েছে; মহান চিন্তক ক্রপথকিন যেমন বলেছিলেন যে, “ কোন রাস্ট্রের পক্ষেই সামগ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থার সুস্ট ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব নয়, ট্রেড ইউনিয়ন গুলো যদি দায়িত্ব গ্রহন না করে তবে বিপর্যয় অনিবার্য”। তবে অবশ্যই শ্রমিক শ্রেনীকে একমত করতে হবে যে তারা যেন বৃহত্তর জনগণের ব্যবহার উপযোগী পন্য উৎপাদন করেন । তাদেরকে উৎসাহিত করতে হবে যে, সকলেই যেন জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নে একেই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেন । মন্ত্রী পরিষদ ও নানা প্রকার কমিটির খেয়াল খুশিমত সিদ্বান্ত চাপিয়ে দেয়া নয় সত্যিকার জনগনের চাহিদার আলোকে সকল কিছু পরিচালিত হবে । তবে কাজের সুবিধার জন্য কমিটি থাকবে । তা হবে খুবই সরল সহজ প্রকৃতির । তা গঠিত হবে কৃষি খামারে আর শিল্প কারখানায় । সকল কমিটিই পরিচালিত হবে শ্রমিকদের ইচ্ছে অনুসারে” । আর তা চালিত হবে শ্রমিকদের স্বার্থে।

উপরোক্ত পরিস্থিতির আলোকে এনার্কো – সিন্ডিক্যালিস্টগন বিশ্বাস করেন যে, সামগ্রীক সামাজিক পরিবর্তনের জন্য সমগ্র শ্রমিক শ্রেনীর লোকদেরকে অবশ্যই সচেতন করতে হবে। যাতে উৎপাদক শ্রেনী “ সামাজিক নিয়ন্ত্রনের মাধ্যমে উৎপাদন সংস্থান, উৎপাদনের নীতিমালা, ও এর সামাজিকিকরন এবং বিকেন্দ্রীকরণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত অবহিত হবেন। এই সকল কাজে নিয়োজিত থাকবে এনার্কো সিন্ডিক্যালিস্ট সংগঠন সমূহ । তাছাড়া উৎপাদন প্রক্রিয়াকে সিন্ডিক্যালাইজেশন করবেন সকল শ্রমিক নিজেদের হাতে, আর এতে নেতৃত্ব দিবে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন, প্রতিটি কারখানা ও ফার্মকে একত্রিত করার জন্য শ্রমিক সংগঠন সমূহ ক্রমে ভোক্তা বান্দ্বব উৎপাদন পরিবেশ সৃজন করবেন”।

রাশিয়ান বিপ্লবের অভিজ্ঞতা বলে, সুসংগঠিত উৎপাদন ব্যবস্থার প্রতিটি উপকরন সাধারন ভাবে পরিবর্তন ও পরিমার্জন করতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যে সিন্ডিক্যালাইজেশনের সময় প্রতিটি কর্ম যেন শ্রমিক বান্দ্বব হয় । প্রতিটি উৎপাদন কারী প্রতিস্টানই হবে তৃনমুলের সাথে সম্পর্কিত তারা উৎপাদনের ব্যবস্থাপনাকে ও সাধারন মানুষের নাগালের মধ্যে রেখে সামগ্রী উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখবেন । প্রতিটি ফ্যাক্টরী পরিচালনার ক্ষেত্রে স্থানীয় শ্রমিকদেরকে ব্যবস্থাপনার জড়িত রাখাবে । উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া নীতির অবসান হবে ।
সাম্যবাদ সফল ভাবে প্রতিটি কারখানায় প্রতিস্টার জন্য, যথাযথ ভাবে প্রতিটি কারখানায় সুস্টুভাবে দক্ষতার সাথে কর্ম সম্পাদনের লক্ষ্যে, সকল প্রকার ব্যাক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত কলকারখানাকে একত্রিকরন করা হবে। একেই সাথে সকল উৎপাদন কেন্দ্র যেন গুন ও মান বজায় রেখে উৎপাদন করতে সেই বিষয়িটি নিশ্চিত করা হবে। এই একত্রিকরন করার ক্ষেত্রে কোন ভাবেই ব্যাক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হবে না, সেই জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত, প্রশাসনিক, তথ্যগত সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সামগ্রীক উৎপাদন ব্যবস্থাপনাকে একেই কমান্ডের আওতায় নিয়ে আসা হবে । ( ক্রপথকিন, পৃস্টা-২৩)
এই পদ্বতীটি বাস্তবায়নের জন্য নিম্নলিখিত পন্থা অনুসরন করা হবেঃ
১। স্বব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ফ্যাক্টরী – কমিউন চালাবে
২। কমিউনের উৎপাদক পরিষদের ফ্যাক্টরী
৩। ইউনিয়নের উৎপাদক পরিষদ
৪। সাধারন শ্রমিকদের কংগ্রেস ( জনগণের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক)।
সকল উৎপাদন প্রক্রিয়াটা সংগঠিত করা হবে উক্ত ব্যবস্থাপনাগত নীতিমালার আলোকে, যেকোন সময়ে রি-কল বা ফেরত নেয়া যায় এমন প্রতিনিধিগনের মাধ্যমে সকল ব্যবস্থাপনা ও নির্দেশনা বাস্তবায়ন ও পর্যবেক্ষন করা হবে । আভ্যন্তরীণ শৃংখলা ও সামগ্রী ব্যবস্থাপনায় যেন কোন প্রকার ব্যাঘাত না ঘটে সে দিকে সবিশেষ নজর রাখা হবে ।
রাশিয়ার বিপ্লবের অভিজ্ঞতা আমাদের শেখায় যে, বৈজ্ঞানিক ও উৎপাদনের সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্বির কাজ অব্যাহত থাকবে, যতক্ষন পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেনী অধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে সক্ষম না হয়ে উঠবেন। পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার উত্তরাধিকার হিসাবে তাদের দৃষ্টিভঙ্গীগত দিক গুলোতে সংকির্নতার প্রশ্রয় পাবে না । প্রচলিত সমাজের বুদ্বিবৃত্তিক লোকেরা বিপ্লবের পর ও তাদের স্ব স্ব কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারবেন, তাদের অধিকার কোন ভাবেই সীমিত বা ক্ষুন্ন হবে না । তবে সামাজিক উত্থানের সূচনা থেকে সকলের সমান অধিকার বজায় থাকবে ।
এটা সত্য যে সূচনা লগ্নেই সাম্যবাদকে সামগ্রীক ভাবে অনুসরন করা যাবে না; “ চাহিদা মত বিতরন” এই নীতি বাস্তবায়নের জন্য বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন কর দরকার হয়ে পড়বে ।
প্রাথমিক ভাবে সকলের জন্য যে নীতিটি বাস্তবায়ন করা হয়ে তা হলো ; “ সকলের জন্য সমান অংশীদারীত্ব”। সমান অংশীদারিত্ব উৎপাদনের ব্যাপক গতি নিয়ে আসবে, সিন্ডিক্যালিস্ট শিল্পে তা ব্যাপক ভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে সর্বস্তরে এই পদ্বতী চালু করা হবে; প্রত্যেকের জন্য তাদের চাহিদার আলোকের বিতরন করার নীতি বজায় থাকবে।
সকলের জন্য সমান অংশীদারিত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে যারা যার উপর নির্ভরশীল তাদেরকে অনুপুরক সাহায্য দেয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে । রেশনিং ব্যবস্থায় পরিমান ততই বাড়বে , কমিউনের উৎপাদন যতই বাড়বে । এছাড়া কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প সম্পর্কে এনার্কো-সিন্ডিক্যালিস্টগন সকল কিছু তাৎক্ষনিক ভাবেই সমন্বিত করে বিশাল আকারে উৎপাদনে যাওয়ার বিষয়ে উৎসাহী নয়। তবে, পারস্পরিক সহযোগিতা, একে অন্যের সাথে মিলে মিশে কাজ করার পরিবেশ তৈরী করা হবে। সকলেই স্বাধীন সিদ্বান্ত গ্রহন করে নিজেদের কাজ করার পূর্ন সুযোগ পাবেন । এনার্কো- সিন্ডিক্যালিস্টগন সকল সময়েই চেষ্টা করে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প গুলোকে একত্রিত করতে এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সহায়তায় তাদের উৎপাদন ও সামগ্রীক ব্যবস্থাপনার বিকাশ ঘটাতে। প্রগতির ছুঁয়া ছাড়া সামগ্রীক উন্নয়ন সম্ভব নয়।

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ মৌলিক শিল্পসমূহঃ

১। কৃষি
কৃষি হল মৌলিক শিল্পের একটি খুবই গুরুত্বপূর্ন শাখা, এটা শুধুমাত্র এইজন্য নয় যে এই কর্মে বেশী সংখ্যক মানুষ জড়িত। এটার বড় কারন হলো এই শাখাটি জাতীয় জীবনে বিশাল অবদান রাখে ।
সাম্যবাদের ভাগ্য ও অনেকাংশেই কৃষির উপর নির্ভর করে । এই খাতটি সাম্যবাদি ধারায় রূপান্তর করতে সময় যেমন বেশী আগে তা আবার জটিল ও বটে। এই খাতে পুঁজিবাদের চেতনা প্রবল, এই খানে প্রযুক্তির ব্যবহার ও শ্রমিকদের সামাজিকিকরনের মধ্যে তা স্পস্টভেবে দৃশ্যমান । সেই কারনেই কৃষি উৎপাদন খাতটি সাংগঠনিক ও প্রকৌশলগত দিক থেকে পশ্চাৎ পদ হয়ে আছে । তাই প্রায় দশ মিলিয়ন কৃষকের সমাহার আজো সংগঠিত হতে পারেনি, ব্যাক্তি কেন্দ্রীক, ক্ষুদ্র মালিকানার স্থরে রয়ে গেছেন, অন্যদিকে প্রকৌশলগত পশ্চাৎ পদতার কারনে সাম্যবাদের পথে এদেরকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া ও বেশ কঠিন কাজ । তাই কঠিন বাস্তবতা হলো তাদের জমির মালিকানার বদল, প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার, উন্নত চাষাবাদ, প্রবর্তন করার জন্য অধিকতর সময় ব্যায় করতে হবে ।

পুঁজিবাদ, ব্যবসায়ীক ভাবে ব্যাক্তিদেরকে একত্রিত করে, তাদের শ্রমকে সামাজিকি করন করে যাচ্ছে, যা সাম্যবাদি সমাজ বিনির্মানের জন্য এক ধরনের প্রস্তুতীর কাজ ও সাম্যবাদি উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলার জন্য সহায়ক । এইটি যান্ত্রিকতায় পূর্ন সাম্যবাদি সংস্থা ও মালিকানার একটি ধরন – এই কারখানা গুলো আগামীদিনের জন্য মুক্ত উৎপাদন ব্যবস্থার প্রাথামিক পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। প্রথামিক পর্যায়ের শিল্প উৎপাদনকারী প্রতিস্টান সমূহ সাম্যবাদি প্রকৃতির এবং সিন্ডিক্যালিজমের জন্য পুঁজিবাদ ও রাস্ট্রের বিপরীতে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির পথে এগিয়ে যাবার পথ তৈরী করছে। সামাজিক শ্রম মালিকানা সিন্ডিক্যালিস্ট সাম্যবাদের উদাহরন হিসাবে পরিগনিত হয়।

এই ধরনের পরিস্থিতি কৃষি ব্যবস্থা থেকে অনেক পৃথক। এই খাতে পুঁজিবাদের সামাজিকি করনের প্রক্রিয়াটি একেবারেই অনুজিবাদেরেই খাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষকের সংখ্যাই অধিক, ব্যাক্তিগত আলিকানা, ব্যাক্তিগত শ্রমের বিনিয়োগ ই বেশী চোখে পড়ে। এই গুরুত্বপূর্ন দিক গুলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থা থেকে সাম্যবাদী সমাজে রূপান্তরিত হওয়ার ক্ষেত্রে বড় বাঁধা হিসাবে কাজ করে ।

শিল্প কারখানায় শ্রমিক শ্রেনীর লোকদেরকে একত্রিত করে দেয়। যা যৌথ মালিকানা গড়ে তুলার জন্য উপযোগী। তবে কৃষি ফার্মের ক্ষেত্রে ও যৌথ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে যৌথ মালিকানা ও গড়ে তুলা সম্ভব ।
কৃষি খাতে যৌথমালিকানা নেই, তবে, তা শ্রমের যৌথতাকে স্পষ্ট করে তুলতে পারে, মিলিয়ন মিলিয়ন কৃষি ক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা প্রাচীন নিয়মেই চলছে। তা ও নানা ভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । তা এখনো আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্বি করা যায়নি। তবে যৌথ মালিকানা শ্রমের যৌথতা নিশ্চিত করতে পারবে । যা নিবিঢ়ভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে অনেক শক্তিশালী করতে পারবে, উৎপাদন বাড়িয়ে কমিউনের সকল মানুষের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। সাথে সাথে প্রাচীন উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়ে নয়া সামাজিক কাঠামোর উদ্ভব ঘটাবে। তবে এই কর্মকান্ড কোন ভাবেই ডিক্রী জারি করে সম্ভব নয় তা করতে হবে ক্রমান্বয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে। আর সেই প্রক্রিয়াটি সম্পাদন রাতারাতি করা সম্ভব নয় তার জন্য দরকার কিছু পদিক্ষেপ গ্রহন করা ।
কৃষিকে সামাজিকিকরন করা দুইটি উপাদানের উপর নির্ভরশীলঃ
১। উৎপাদনের প্রধান মাধ্যমকে সামাজিকি করন। যেমন- জমি ।
২। শ্রমের সামাজিকি করন ।
ভূমির সামাজিকিকরন হলো একটি বিপ্লবী পদক্ষেপ এবং এই পদক্ষেপ সফল হয় বাধ্যতামূলক আইনের মাধ্যমে; শ্রম শক্তিকে সামজিকিকরন হলো একটি প্রক্রিয়া মাত্র, এই ধরনের কার্যক্রমের জন্য যে সামাজিক প্রস্তুতি দরকার এখনো সম্পন্ন হয় নাই। তবে অবশ্যই সামাজিক ভাবে যৌথতা বিষয়ে সচেতনতা সৃজনের মাধ্যমে মালিকানার ধারনা পাল্টাতে হবে এবং সমাজবাদের জন্য অনুকুল পরিবেশ তৈরী করতে হবে ।
কৃষির যৌথতা, একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয় তা কোন ঘটনা চক্রে হবার কথা নয় । তা হতে হবে পরিকল্পিত ও জন অংশ গ্রহনের ভেতর দিয়ে । আর সেই কারনেই এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজম যে কার্যক্রম গ্রহন করেছে তাতে দুইটি বিষয় যুক্ত রাখতে হবে বলে জোর দিচ্ছেঃ জমির সামাজিকিকরন ও শ্রমের সামাজিকি করন ।
১। জমির সামাজিকি করন
১। জমির সকল প্রকার মালিকানার অবসান করতে হবে – ব্যাক্তিগত, দলীয়, সমবায়, সামরাদায়িক, পৌরসভা বা রাস্ট্রের যাই হোক না কেন তা জনগণের সম্পত্তি হিসাবে স্বীকৃত হবে ।
২। জমিকে সামাজিকি করনের ফলে জমি পন্য হিসাবে বাজার থেকে প্রত্যাহার করা হবে; জমি কেহ ক্রয় করতে, বিক্রয় করতে, ভাড়া দিতে পারবে না । সকলেই জমিতে ব্যাক্তিগত ভাবে বা যৌথ ভাবে কাজে নিয়োজিত হবেন।
৩। প্রতিটি ব্যাক্তি জমিতে সমান অধিকার লাভ করবেন, সমভাবে নিজের স্বাধীন শ্রম বিনিয়োগের জন্য অধিকার পাবেন।
৪। জমির প্রাপ্যতা সাপেক্ষে প্রত্যেক্যে সমপরিমাণ জমি ব্যবহারের জন্য প্রদান করা হবে। এই বিষয়ে সিদ্বান্ত নিবে জাতীয় কৃষক কংগ্রেস। যা গঠিত হবে সাধারন শ্রমিক কনফেডারেশনের অংশ হিসাবে ।
৫। প্রতিটি শিল্প কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন সমূহ তা পরিচালনার দায়িত্ব নিবে, অন্য দিকে জমির সামগ্রীক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিবে কৃষক সমতি।
২। শ্রমের সামাজিকি করনঃ
১। ভূমির সামাজিকি করন হলো কৃষি শ্রম সামাজিকিকরনের প্রাথমিক শর্ত । যে ক্ষেত্রে কেবল শ্রম ও মালিকানা সামাজিকিকরন করা হয়, সেই ক্ষেত্রে উৎপাদনের হার কমে যেতে পারে। তাই সত্যিকার সাম্যবাদের জন্য সামগ্রীক ভাবে সব কিছুই সামাজিকিকরনের জন্য কাজ করতে হবে ।
২। যে সমাজটি বিপ্লবের ভেতর দিয়ে এগিয়ে আসে, তা ক্রমে উৎপাদন ব্যবস্থাকে সামাজিকি করন করা হয়, এই সমাজের কৃষি ব্যবস্থাকে ও সমান গুরুত্ব দিয়ে সাম্যবাদের আদর্শে রূপায়ন করার কাজ চলতে থাকে। গ্রামীন ও শহরের জনসংখ্যার মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করে একটি ভারসাম্য পূর্ন পরিবেশ গড়ে হয়। ক্রমে পুরাতন ও প্রচলিত ব্যবস্থা ও প্রতিস্টানের বিলুপ সাধন করা হয় ।
৩। সামাজিকিকরন কৃত কৃষিব্যবস্থা সাম্যবাদি কৃষি ব্যবস্থার সাথে সম্পূর্ন ভাবে একাকার হয়ে যেতে পারে। বিপ্লবের সূচনা থেকেই কৃষি সংগঠন সমূহ সাম্যবাদি কার্যক্রমের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হিসাবে পরিগনিত হবে ।
কৃষিতে সাম্যবাদের প্রয়োগ প্রক্রিয়ায় এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমের দৃষ্টি ভঙ্গী হলো ছোট কৃষকদেরকে বিলুপ্ত না করা বা কেবল বড় বড় কৃষি ফার্ম স্থাপন না করা । তারা মনে করে মানুষের উপর বাধ্যতা মূলক শ্রম চাপিয়ে দেয়া প্রতিক্রিয়াশীলতার নামান্তর। তাই, সকল শ্রম শক্তিকে এক একটি ক্ষদ্র ইউনিট হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে স্বেচ্ছাকৃত ও স্বাধীন বিষয় হিসাবে বিবেচনা করে সাম্যবাদি ধারায় প্রবাহিত করার প্রয়াস চালায়।
এভাবেই অর্থনৈতিক ইউনিট গুলো রূপান্তরিত হবেঃ ক) সমবায় ভিত্তিতে সচেতন ভাবে কৃষি সংশ্লিষ্ট জনগণকে ক্রমে ব্যাক্তিগত সম্পত্তির ধারনা থেকে বেড় করে যৌথ মালিকানার ধারনায় উন্নিত করা হবে । খ) কৃষি খামারের যৌথ করনের পাশাপাশি উৎপাদনকারী কল কারখানা সমূহকে এবং অন্যান্য সামগ্রীক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে সাম্যবাদি ধারায় নিয়ে আসতে হবে ।
৪) সুদক্ষ ভাবে কৃষি উৎপাদন পরিচালনার জন্য কৃষি খামার গুলোকে খুব বেশী বড় আকারে তৈরী করা হবে না । সাধারন ভাবে সেই সকল খামারকে দশ জন কৃষক দিয়ে গড়ে তুলা হবে। যারা পাশা পাশি অবস্থানে আছেন তাদেরকেই প্রাধান্য দেয়া হবে । তবে স্থান বিশেষে এর সংখ্যা কম বেশী হতে পারে । তবে সকলের পরিবার ও পারিবারিক কার্যক্রমকে একত্রিত করা হবে না । পরিবার গুলো পৃথকই থাকবে।
৫) কৃষি কার্যক্রমের আওতায় অন্তর্বত্তীকালিন সময়ে তিন ধরনের সংগঠন থাকবেঃ ক) স্বতন্ত্র খ) সমবায় এবং গ) সাম্যবাদি । স্বতন্ত্র ধারার সংগঠন সমূহ প্রথমিক ভাবে তেমন উল্লেখ যোগ্য ভাবে গড়ে তুলা হবে না ।
৬) ব্যাক্তিগত পর্যায়ের অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে খুবই দ্রুত ও সফল ভাবে রূপান্তরের কাজ করা হবে । এছাড়া অন্যান্য ভোগ্যপন্য-উৎপাদন কার খানা গুলোকে ও ব্যাক্তিগত অবস্থা থেকে যৌথ ব্যবস্থার দিকে যৌক্তিক সময় ও পদ্বতী অনুসরন করে অর্থনীতিকে সামাজিকি করনের মাধ্যে সাম্যবাদ কায়েম করা হবে । সেই কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দুই ধরনের পদ্বতী অনুসরন করা হবে। ক) আক্রমনাত্মক এবং খ) রক্ষণাত্মক ।
১। আক্রমনাত্মক ব্যবস্থায় কৃষি শ্রমিকদেরকে সরাসরি কাজে নিয়োগ দেয়া হবে এতে থাকবেঃ
১। যারা ইতিমধ্যেই কৃষি কাজে জড়িত আছেন তাদেরকে সেই কাজেই রাখা হবে, তবে তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্বির পদক্ষেপ নেয়া হবে। একেই ধারায় সামিজিকিকরনের কাজ হবে কল কারখানায় ।
২। যে সকল ব্যবসা বানিজ্য কৃষি পন্য নিয়ে কাজ করছে তাদেরকে সাম্যবাদি ধারায় রূপান্তরিত করা হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে ও একেই পদ্বতী অনুসরন করা হবে ।
৩। কৃষি ভিত্তিক শিল্প সমূহের সামাজিকি করন ও সমবায়ী করনের নিবিঢ় ভাবে সম্পাদন করার জন্য যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হবে। যেমন- চিনি, টেক্সটাইল, সিগারেট, এবং নানা প্রকার ফলের জুস ইত্যাদিকে সাধারন ভাবে সাম্যবাদি ধারায় রূপান্তর করা হবে ।
৪। বড় আকারের আটা-ময়দার কল এবং সিরামিক্সের কারখানা ও সাধারন প্রক্রিয়ায় সামিজিকি করন করা হবে।
৫। চাষাবাদ যোগ্য জমির উন্নত চাষাবাদের জন্য সমিতি উদ্যোগ নিবে।
৬। পুর্নাংগ সাম্যবাদি সমাজ গড়ে তুলার জন্য কৃষিতে পুর্বিন্যাস সাধন করা হবে ।
৭। কৃষিকে শিল্প ভিত্তিক খাত হিসাবে রূপান্তর করা । কৃষি পন্যকে কারখানার সাথে সমন্বয় সাধন করা। উপযুক্ত কৃষির জন্য উপযুক্ত এলাকা নির্বাচন এবং উপযুক্ত কারখানা স্থাপন করে উৎপাদন বৃদ্বি করা । যেমন- চিনি, ফলমূল, শাক সবজি, মদ, সিগারেট, বিয়ার ইত্যাদি। কৃষি ভিত্তিক কল কারখানা ও কামার গড়ে তোলে সাংগঠনিক পদ্বতী অনুসরন করে উৎপাদন ব্যবস্থায় নবযুগের সূচনা করবে । তাই বিশেষ কিছু পদক্ষেপ গ্রহন করা হবেঃ
১। সাম্যবাদি শিল্পের উদ্যোগতাগন তাদের নিকটবর্তী ব্যাক্তিগত উদ্যোগ সমূহকে সহযোগিতা করার প্রায়স চালাবেন। কৃষি ভিত্তিক সমাবায় গুলোকে শক্তিশালী করে রাশিয়ার ক্রিমিয়ারী সমাবায় সমূহের মত করে গড়ে তুলা হবে ।
২। কম্পোজিট কৃষি-শিল্প গুলোকে পরস্পরের সাথে একটি সংযোগ সৃজন করতে হবে। যেন কার্মীগন মৌসুম ভিত্তিক কাজ করতে পারেন। যখন কৃষিতে কাজ কম থাকবে তখন তারা শিল্পে সময় দিবে এবং যখন কৃষি শিল্পে বেশী কাজ থাকবে তখন শিল্প শ্রমিকগন সেখানে গিয়ে প্রয়োজন অনুসারে সময় দিয়ে কাজ করবেন ।
৩। পারস্পরিক সহযগিতা মূলক চেতনায় লালিত শ্রমিক কর্মীগন নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে নিজেদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন। সেই সহযোগিতা অনেক সময় কয়েক দিন, কয়েক ঘন্টার জন্য কর্ম বিনিময়ের ব্যবস্থা রাখা হবে । যাতে খামার ও শিল্পের মধ্যে একটি সংযোগ দৃড়ভাবে গড়ে উঠে ।
২। সুরক্ষামূলক ব্যবস্থাগ্রহন করা । যেমন – মিলিয়ন মিলিয়ন ব্যাক্তিগত ফার্মের সাম্যবাদি অর্থ ব্যবস্থায় অব্যস্থ করে গড়ে তুলার লক্ষ্যে নিবিড় ভাবে কাজ করে সমবায় বিত্তিক ধারায় নিয়ে এসে ক্রমে সাম্যবাদি ব্যবস্থায় রূপান্তর করতে হবে ।
আত্মরক্ষামূলক পদ্বতী সমূহ সকল সময়েই পরিবর্তনকালিন কিছু সময়কে কাজে লাগায়, সেই সময়ে প্রতিটি প্রতিস্টানকে নতুন ভাবে ঢেলে সাজানোর জন্য বা কিছু প্রতিস্টানকে বিলুপ্ত করার লক্ষ্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করে থাকে। সেই গুলোকে সত্যিকার স্বাধীন ভোক্তা উৎপাদকে রূপান্তর করে দেয় । তবে তা কোন ভাবেই পুঁজিবাদের আওতায় পরিচালিত সমবায়ের মত নয়। সকল পরিবর্তনের লক্ষ্যই হলো সত্যিকার সাম্যবাদের দিকে চালিত করা । স্থানীয় উদ্যোগে যৌথতাকে উৎসাহিত করা ও ফেডারেটিভ সংস্কৃতির বিকাশ সাধন করা ।
অন্তবর্তী কালিন সময়ে সমবায় ভিত্তিক কৃষকদের কাজ হবে তাদের চার পার্শের ব্যাক্তিগত খামারিদেরকে জাতীয় অর্থনীতির মূল ধারায় সম্পৃক্ত করা। তাদেরকে ক্রমে প্রকৃতিক জীবনের সাথে অভ্যস্থ করে যৌথ খামারের রীতিনীতির সাথে সম্পৃক্ত করে গড়ে তুলা । শোষণ মুক্ত পরিবেশে বিকশিত হবার পরিবেশ তৈরী করে দেয়া ।
যৌথ খামারের মৌলিক ও প্রাথমিক ভিত্তি হবে গ্রামীন কৃষি সমিতি, তারা উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় সহ সকল কর্ম সম্পাদন করবেন। প্রযুক্তিগত যন্ত্রপাতি সহ সকল আধুনিক উপকরনের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ও তাদের উপরই অর্পিত হবে। গ্রামীন সমিতির ফোরাম সমূহ সারাদেশের কউন্সিলের সাথে যুক্ত হবেন তাদের মাধ্যমেই সামগ্রীক ব্যবস্থাপনার জন্য পরিচালনা পরিষদ গড়ে উঠবে। এই পরিষদ সাম্যবাদি সমাজের বিনির্মানে নেতৃত্ব দিবেন। যাদের কাজ হবে সকল মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিনতা নিশ্চত করা ।
কৃষি ঋন ও পন্য সরবরাহের জন্য কৃষি ব্যাংক স্থাপন করবে সাম্যবাদি অর্থনীতি, তাদের কাজ হবে কৃষি সংস্থা সমূহকে সহায়তা করা। এই ব্যাংক সমূহ কৃষি ঋন প্রদানের পাশা পাশি পন্য আদান প্রদান করবেন স্থানীয়, আঞ্চলিক, দেশ ও বিদেশে। যাতে সামগ্রীক ভাবে কোথাও কিছু অভাব অনুভূত না হয় ।
যেহেতু গ্রামীন সমিতি গুলো মৌলিক ফোরামের ভেতর থেকেই বিকশিত হবে, সেহেতু, তারাই জমির বন্ঠন করার কাজ সহ পরস্পরের মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রায়স চালাবেন । প্রত্যেকের কার্যক্রম নির্ধারন ও সীমা ঠিক করে দিবেন। স্ব স্ব ক্ষেত্রে সকলেই যেন মুক্ত ভাবে সৃজনশীলতার সাথে কাজ করতে পারেন ।
পশু পালনঃ
অন্যান্য চাষাবাদের মত গরু ছাগল পালন করা ও প্রতিটি দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ন কাজ, সারা দুনিয়ায় এমনটি ব্যাপক ভাবেই হয়ে থাকে । কোন সমাজ বা দেশ যখন বিপ্লব সাধন করে তখন এই জাতীয় কাজের গুরুত্ব আরও অনেক বেড়ে যায়। কৃষি কাজের সাথে পশু পালন করার কাজটি কেবল যুক্ত করলেই হবে না । তার আরও বিকাশের জন্য অধুনিক পথ ও পন্থা খোজে দেখতে হবে । অধিক হারে উৎপাদন করে মানুষের চাহিদা মেটানো একটি গুরুত্বপূর্ন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
পশু পালনের যে খামার গড়ে তুলা হবে তা যেহেতু কৃষি খামারের সাথেই যুক্ত থাকবে তাই এটাকে ও প্রথমিক স্তরে বানিজ্যিক ভাবে উন্নয়ন করা হবে। এই খামারের মধ্যে থাকবে মাংশ, দুধ, মুরগী ইত্যাদি। এইসকল খামার ও সামাজিকি করন করা হবে ।
সামগ্রীক কৃষি ব্যবস্থার সামাজিকি করনের আগে, পুশুপালন প্রকল্প সমূহকে একটি পদ্বতীর আওতায় নিয়ে আসতে হবে, তাদের প্রজনন ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সমবায় এবং শিল্প সমূহ পশু পালন ব্যবস্থাকে আরও শক্তি শালী করবে ।
গরুর প্রজনন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য তাকে কৃষি শিল্পের সাথে সমন্বয় করা হবে, শিল্প কারখানাকে যে প্রক্রিয়ায় সামাজিকিকরন করা হয়েছে তেমন পশু পালন পদ্বতীকে ও বিশেষ ভাবে গড়ে তুলা হবে । এখানে গরুর উৎপাদন, মোটাতাজাকরন, জবাইকরন ঘর নির্মান, মাংশ কাটা ও প্যাকেটিং করা, এবং চাহিদা মোতাবেক সরবরাহ করা ইত্যাদি কাজ খুবই দক্ষতার সাথে সম্পাদন করা হবে ।
তবে আদিবাসি যারা পূর্ব থেকে গরু ছাগল ভেড়া সহ নানা প্রকারের জীব জন্তু পালন করে এসেছে তাদেরকে চাপ দিয়ে এই আধুনিক পদ্বতীতে আনা হবে না । তাদেরকে তাদের মতই কাজ করতে দেয়া হবে । চিন্তা চেতনায় যখন তারা আধুনিক পদ্বতী গ্রহনের স্তরে উন্নিত হবে তখনই কেবল তাদেরকে সামাজিকিকরনের মূল ধারায় যুক্ত হবে । তবে তাদের মধ্যে সমবায় পদ্বতী ও সাম্যবাদি অর্থনীতির সুফল সমূহ তোলে ধরা হবে । কৃষি ব্যাংক সমূহ তাদেরকে অর্থ ও পন্য সহায়তা দিয়ে যাবে। তাদের এলাকা সমূহে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য রাস্তা ঘাট নির্মান করে দেয়া হবে।যাতে তারা সহজেই শহর নগরের সাথে যুক্ত হয়ে নিজেদের উৎপাদিত পন্য ক্রয়বিক্রয় করতে পারেন। এমন কি দূর দূরান্ত থেকে যারা আসবেন তাদের জন্য পথে থাকা-খাওয়ার সু ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।
গবাদি পশুপালন ও শাক-সব্জিবাগানঃ
যেহেতু, শাক-সব্জির বাগান কৃষি কাজের থেকে বিচ্ছিন কোন খাত নয়, তাই যে সকল সবজি বাগান বানিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে সেই গুলিই সামাজিকি করন করা হবে । সামাজিকি কৃত খামার গুলিকে ও আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো হবে। সকল প্রকার বৈজ্ঞানিক কলা কৌশল ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্বি করা হবে । যাতে সকলের চাহিদা মেটানো যায়।
বনজ সম্পদঃ
বনজ সম্পদ ও একটি মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ । যে সকল খালি জমি আছে তাতে ব্যাপক ভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্বতীতে বনায়ন করা হবে । এই বনে উৎপাদিত সকল সম্পদ সকলের স্বার্থে ব্যবহার করা হবে ।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় কাস্ট অর্থনীতিতে বরাবরই লুট পাট চলে এসেছে, ফলে নানা দেশের বন বিভাগ বিনষ্ট হয়েছে। কিন্তু আমাদের ভূমির মাটি ও আবহাওয়া বা জলবায়ুর সুরক্ষার জন্য বনজ সম্পদের বিকাশ ও রক্ষণ করা অতিব জরুরী বিষয়। বনজ সম্পদ কেবল নির্মান শিল্প বা জ্বালানীর উপকরন নয় বরং অনেক উৎপাদক কারখানার গুরুত্বপূর্ন উপাদান সরবরাহ কারী । এটা কেবল জীব জন্তু আর পাখীর আধার নয় বরং তা থেকে নদি নালার উৎপত্তি হয় এবং মাটির আদ্রতা রক্ষায় বিশাল ভূমিকা পালন করে থাকে । যা কৃষি কাজের জন্য অতিব জরুরী বিষয় । তাই সামগ্রীক কল্যানার্থে বনজ সম্পদের সুরক্ষা দরকার। বনজ সম্পদকে অবশ্যই সামাজিকি করনের আওতায় আনা হবে। সকল প্রকার ব্যাক্তি ও রাষ্ট্রীয় মালিকানার বসান ঘটাতে হবে। এটাকে করা হবে সামাজিকিকরনের মাধ্যমে একটি অবানিজ্যিক উদ্যোগঃ এই সম্পদ কেহই বিক্রি বা ক্রয় করতে বা ভাড়া দিতে পারবে না ।
কৃষি ভিত্তিক জেলা গুলোতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বন ভূমি গড়ে তুলা হবে, তা কোন ভাবেই সামাজিক শিল্প গুলোর দ্বারা নষ্ট করার সুযোগ দেয়া হবে না, সেই বন ভূমি গুলো কৃষক সমতির নিয়ন্ত্রনে দিয়ে দেয়া হবে । দরকার হলে জ্বালানী না নির্মান কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে । অন্যান্য বন ভূমি গুলো সিন্ডিক্যালিস্ট পদ্বতীতে সাম্যবাদি অর্থনীতির আওতায় সামগ্রীক ব্যবস্থাপনার জন্য ফেডারেশনের নিকট ন্যস্ত হবে ।
যদি কোন অঞ্চলে কাঠের অভাব হয় তবে সামাজিক বনজ সম্পদ থেকে সমাবায় ও ব্যাংকের মাধ্যমে তা পুরনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে ।
বনজ সম্পদ সামাজিকি করনের ফলে বনায়ন ও কাঠ শিল্প ব্যাপক ভাবে মানুষের ব্যবহারের উপযোগী করে তুলা হবে। যে সকল কাঠ শিল্প গৃহ সজ্জার কাজে জড়িত তাদেরকে সমন্বিত করে সমাবায় ভুক্ত করা হবে। ক্রমে তাদেরকে সাম্যবাদি ধারায় যুক্ত করে নেয়া হবে । কাঠ শিল্পলের সাথে সম্পর্কিত বন ভূমি কৃষি খামার ও পশুখামার ইত্যাদির মধ্যে একটি চমৎকার সমন্বয় সাধন করা হবে । যারাএই কাজে উৎসাহী ও দক্ষ তাদেরকে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দিয়ে তাদের শ্রমের সত্যিকার মর্যাদা দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে ।
মাছের চাষ ও শিকারঃ
ক) মাছের চাষ
সাম্যবাদি অর্থনীতিতে সকল জলাশয় ও জসলজ সম্পদ জাতীয় করন করা হবে । মাছের চাষ ও ক্রয় বিক্রয় এই প্রক্রিয়ায় সম্পাদন করা হবে । ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চাষীদেরকে প্রথমে সমবায়ের আওতায় আনা হবে । পোনা উৎপাদন ও মাছ ধরার জন্য বিশেষ দল কাজ করবেন। মাছের নানা প্রজাতির সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত স্থান সমূহে মাছের জন্য অভয়ারণ্য স্থাপন করা হবে।
খ) শিকার
সাম্যবাদি বনাঞ্চলে শিকারের ব্যবস্থা ও রাখা হবে। সমবায় সমিতি সমূহ সেই ব্যবস্থা করবে। সেই ব্যবস্থা করার জন্য ক্রয় ও বিক্রয় কমিটি এবং ব্যাংক সমূহ নগদ অর্থ ও পন্য বা উপকরন দিয়ে সহায়তা দান করবে । আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকেরা তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বিশেষ ভাবে শিকারের অংশ নিতে পারবে । নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় বনাঞ্চল ও শিকারের স্থান সমূহ সংরক্ষন করা হবে ।
খনিজ শিল্পঃ
উৎপাদন শিল্পের মতো খনিজ সম্পদ নিষ্কাশন সম্পর্কিত শিল্পের সেই শাখাগুলি পুঁজিবাদী বিকাশের আওতায় পড়েছে, যা সামাজিকীকরণের পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এবং সাধারণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় তাদের গুরুত্ব সত্যিই বিশাল যে তাদের সামাজিকীকরণ অনুজ্ঞাসূচক. সেই কারণে সাম্যবাদি সমাজকে সামাজিক বিপ্লবের প্রথম থেকেই খনিজ সম্পদগুলিকে সম্পূর্ণ সামাজিকীকরণ থেকে ঘোষণা করতে হবে।
১। দেশের সকল বৃহৎ শিল্প কারখানা গুলোকে সাম্যবাদি অর্থনীতির স্বার্থে সিন্ডিক্যালাইজেশন করে নিতে হবে।
২। সাম্যবাদি অর্থনীতির অনুকূলে সকল প্রকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুটির শিল্পকে সমবায়ের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
৩। খনির শিল্পের বিভিন্ন শাখার শিল্পায়ন, যেমন সমন্বিত শিল্পের ভিত্তিতে যৌথ ইউনিটগুলির মাধ্যমে রাসায়নিক, ধাতব ও অন্যান্য প্রক্রিয়াকরণের শিল্পের শাখার সাথে তাদের একীকরণ করতে হবে।
৪। শিল্প সম্পর্কিত উৎপাদন শাখার শিল্পায়িত ও অ-শিল্পিত উদ্যোগের গ্রামীণীকরণ, যেমন যৌগিকভাবে কৃষির সাথে তাদের ঐক্যবদ্ধতা ক্রমশ একীকরণের নীতির ভিত্তিতে আশেপাশের কৃষির জনসংখ্যা ও শ্রম সংগঠিত করে তাদের অর্থনৈতিক কক্ষপথে আঁকড়ে ধরে রাখার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে।
৫। প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের কারখানার মতোই খনিজ সম্পদ উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় বিশেষ বিবেচনায় রাখা হবে। সমিতির উত্পাদন কমিটির দ্বারা শিল্প কারখানা পরিচালিত হবে।

Comments

Related content