শ্রমিক এবং রাষ্ট্র মূলঃ ম্যাক্স স্টার্নার ভাষান্তরঃ প্রবাল

Submitted by akmshihab on December 1, 2018

শ্রমিক এবং রাষ্ট্র
মূলঃ ম্যাক্স স্টার্নার
ভাষান্তরঃ প্রবাল
---------------------------

সরকার কখনই আমাকে নিজ থেকে মূল্য দিতে চায় না এবং আমি যেন মূল্যহীন থাকি সেটাই তাদের একমাত্র কাম্যঃ তারা সবসময় আমাকে ব্যবহার করে লাভ করে নিতে চায়,আমার গায়ে সব দোষ চাপায় ,তারা আমাকে ব্যবহার করে ,এমনকি তারা আমাকে কাজে লাগিয়ে প্রলেতারিয়েতের নিরবিচ্ছিন্ন সাপ্লাই পেতে চায় ;তারা চায় তাদের 'অধীন লোক' হিসাবেই যেন আমি সবসময় থাকি।

আমার এই চরম দরিদ্র অবস্থার অবসান তখনই ঘটবে যখন আমি আমার নিজের মূল্য বুঝতে পারব এবং একই সাথে নিজেকে মূল্য দিতে শুরু করব। পৃথিবীতে আমাদের বিপ্লবের বীজের অঙ্কুরোদগমের লক্ষ্যে আমাকে বিদ্রোহ করা শিখতে হবে।

যখন আমি মাটি থেকে পরিশ্রম করে ময়দা ,সুতা ,কয়লা কিংবা লোহা উৎপাদন অথবা উত্তোলন করি, তখন আমি আমার সে কাজগুলোর মূল্যায়ন চাই। কিন্তু, তারপর আমি একটি সুদীর্ঘ অভিযোগ করতেই পারি যে কাজের মূল্যমান অনুযায়ী আমাকে বেতন দেয়া হয় নিঃ কিন্তু আমার সে আর্জি শোনা হবে না এবং সরকারও বাকি সবার মত আমার দাবির প্রতি উদাসীন থাকবে, কারণ তারা মনে করে যেহেতু আমি কোনদিনই আমার ভয় ভাঙতে পারব না, সুতরাং আমার ক্ষোভকে তারা সহজেই 'প্রশমিত' করতে পারবে। কিন্তু, এ পর্যন্তই সই। যদি এরপর আরো বড় কোন দাবি নিয়ে আমার মাথা তুলি সরকার তার সিংহের পা এবং ঈগলের থাবার ন্যায় সমস্ত শক্তিগুলো নিয়ে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বেঃ সহসাই তারা তখন মানুষের রাজা থেকে সিংহ এবং ঈগলের ন্যায় পশু হয়ে পড়বে।

তারা আমার উৎপাদিত পণ্য এবং শ্রমের জন্য যে মূল্য নির্ধারণ করেছে, সেটা নিতে যদি আমি অস্বীকৃতি জানাই, যদি আমি নিজে আমার উৎপাদিত পণ্যের মূল্য নির্ধারণের মত উচ্চাকাঙ্ক্ষী হই অর্থাৎ "নিজেকে নিজে বেতন দেয়ার" মত অবস্থাতে যদি আমি চলে যাই, তখন আমার ঐ পণ্য যারা কিনতে চান সে সমস্ত ক্রেতাদের সাথে আমার সংঘর্ষ বাঁধতে বাধ্য ।

যদি এই কাজটি মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং (পারস্পরিক বোঝাপড়ার) মাধ্যমে হয়,সরকার তাতে কোন আপত্তি করে না; ব্যক্তি পরস্পরকে কীভাবে মোকাবেলা করবে এটা তাদের বিন্দুমাত্র ভাবায় না, যতক্ষণ না ব্যক্তি তাদের চলার পথে কাঁটা হয়ে দাড়ায়।তাদের ধ্বংস ও বিপদ তখনই শুরু হয় যখন ব্যক্তি আর তাদের মানতে চায় না, সেটেলমেন্টের পরিবর্তে যখন তারা চুল পরিমাণ অংশীদারিত্বেরও হিসাব চায় তখনই বিপত্তিটা বাঁধে।মানুষ সরাসরি মানুষের সাথে সম্পর্কিত হবে এটা সরকার কখনোই অনুমোদন দিতে চায় না ;সরকারের মতে এটা অবশ্যই মধ্যস্থতাকারীর উপস্থিতি মারফত হতে হবে, অর্থাৎ দালাল থাকতেই হবে।

সরকার তার উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে খ্রিস্ট থেকে শুরু করে সেইন্টের দল, চার্চ সবাইকেই "মধ্যস্থতাকারী দালাল" বানিয়েছিল। ওই সমস্ত দালালেরা মানুষে মানুষে সম্পর্ক টুকরো টুকরো করে তাদের মধ্যে "আত্মা" নামক উদ্ভট বস্তুটিকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। শ্রমিকেরা যখন উচ্চ মজুরির দাবি করে সরকার তখন দালালদের দিয়ে তাদের জোর করে ক্রিমিনাল বানিয়ে দেয়।

শ্রমিকেরা তখন কি করবে? সরকারের উপর বাধ্যবাধকতা আরোপ করা ছাড়া তারা তাদের দাবি আদায় করতে পারে না ;আবার উল্টোদিকে শ্রমিকের উপর বল প্রয়োগ করে সরকার শক্তিশালী হতে থাকে, পণ্যের মূল্য তখনো নির্ধারিত হতে থাকে তাদের ইচ্ছার মাধ্যমেই।এমতাবস্থায় শ্রমিকেরা কি করতে পারে তাদের নিজেদের দূরাবস্থার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া ? সরকার তখনো তড়তড় করে নিজের কাজ চালিয়ে যায়।

এই অবস্থা যে কেবলমাত্র আমার শারিরীক শ্রমের বেলায় প্রযোজ্য তা কিন্তু নয়,আমার বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমের বেলায় তা আরো প্রকট। সরকার আমার সমস্ত চিন্তারও মূল্য নির্ধারণ করে এবং তা বেঁচার জন্য খরিদ্দার জোগাড় করে আনে (যদিও আমি আমার কাজের জন্য মূল্য দাবী করি না, আমার কাজ শ্রোতাদের কাছ থেকে আমাকে সম্মান এনে দেয়) । কিন্তু এই সম্মান ততক্ষণই পর্যন্তই আসতে থাকে আমার কাছে যতক্ষণ পর্যন্ত আমার চিন্তা তাদের চিন্তার সাথে খাপে খাপ মিলে যায়।

অন্যদিকে যদি আমি আমার গানে কিংবা বক্তব্যে এমন সমস্ত কথা আনি যা শ্রোতাদের চিন্তার সাথে মিলে না, তারা আমার সেই সমস্ত কাজের মূল্য নির্ধারণ করে আমাকে তাদের সাথে ভালোবাসার ব্যবসায় নামতে দেয় না। আমার চিন্তা তখনই মুক্ত থাকে যখন তা সরকারের কৃপাধন্য হয়; আর আমার যে চিন্তাগুলো সরকারের কৃপাধন্য সেগুলো আদতে সরকারেরই চিন্তা। তারা আমার দর্শনগুলোকে ততক্ষণই নিজেদের মনে জায়গা দেয় যতক্ষণ আমি নিজেকে একজন "সরকারি দার্শনিক" হিসেবে প্রমাণ করতে সমর্থ হই; সরকারের বিরুদ্ধে আমার দর্শন কপচালে চলবে না।আমার দর্শন তাদের সাহায্য করলে তারা যেমন পুলকিত হয় তেমনি তাদের বিরুদ্ধে আমার আনা "প্রতিরোধগুলো" তাদের প্রচুর বিরক্ত করে।

কিন্তু, তারপরও আমার ইচ্ছার কারণে আমি সরকারের আনুগত্য চাই না, তাদের প্রশংসাপত্র নিয়ে আমার কাজের বৈধতা চাই না। তাদের মনমতো কাজ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হবার কারণেই হয়তো আমি আমার কাজের সঠিক মূল্যায়ন পাই না। আমার পথ অবশ্যই তাদের পথ হতে হবে নচেৎ তারা আমাকে আটক করে রাখবে, আমার চিন্তা অবশ্যই তাদের চিন্তার সাথে মিলতে হবে নাহলে তারা আমার মুখ বন্ধ করে দিবে।

আমাকে মূল্য দেয়ার চেয়ে বড় ভীতিকর কাজ সরকারের আর কিছুই হতে পারে না এবং আমি যেন নিজে নিজের মূল্যমান ঠিক করতে না পারি সে বিষয়ে তারা সবসময় সতর্ক দৃষ্টি রাখে। আমি হলাম সরকারের জাত শত্রু। আমার এই বিরুদ্ধ অবস্থান জনতাকে সবসময় বাছাই করে নেবার দোলাচালে রাখে, হয় তারা নয়তো আমি।

Comments

Related content