এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমঃ তত্ত্ব ও প্রয়োগ

এনার্কিজম বা নিরাজবাদ মানব সমস্যার সমাধানের জন্য কোন চিরন্তন বানী নয়, এটা আবার কোন কল্পনা প্রসূত মতবাদ ও নয়, এই মতবাদ যেকোন চিরন্তন বানী বা মতবাদ বিরুধী। এটা কোন চিরন্তন সত্যে বিশ্বাসী নয়, বা মানবজাতির চূড়ান্ত মতবাদ হিসাবে ও দাবী করে না ।

Submitted by akmshihab on May 16, 2018

গ্রন্থঃ এনার্কো-সিন্ডিক্যালিজমঃ তত্ত্ব ও প্রয়োগ

মুল লিখকঃ রুডলফ রকার, অনুবাদঃ এ কে এম শিহাব

এনার্কিজম বা নিরাজবাদঃ উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, (চতুর্থ কিস্তি)

দুনিয়ায় ঐতিহাসিক উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাহ্যিক ভাবে নানা প্রকার পরিবর্তন হয়েছে, কিন্তু তাঁর কার্যক্রমে ধরন প্রকৃতি আগের মতই নিপীড়ন মূলক রয়ে গেছে। শাসকগন ও তাঁদের সমর্থকদের বা অধিনস্থদের কর্মপরিধি বাড়িয়েছে। রাষ্ট্র সে গণপ্রজাতন্ত্রী হোক, বা রাজতান্ত্রিক হোক ইতিহাসের কোন কালেই তাঁরা নিপীড়ন মূলক কার্যক্রম থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে নাই। তাঁদের জাতীয় সংবিধানের পরিবর্তন আনয়ন করে ও তাঁদের চরিত্রগত পরিবর্তন সাধন করতে পারেনি। বিজ্ঞানের বদৌলতে, গাছ, পালা, পশু, পাখী ও মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরিবর্তন করা যায় । পরিবর্তন করলে ও চোখ, কান, নাক বা অন্যান্য অঙ্গের যে ধরনের কাজ তাঁর কোন পরিবর্তন হয় না ।। তেমনি সামাজিক প্রতিস্টান সমূহের মাঝে পরিবর্তন সাধন করে ও তাঁদের কাজের ধরনের কোনই পরিবর্তন হবে না । সামাজিক মুক্তি আসবে না । রাষ্ট্র যা তাই ই থেকে যাবে চিরকালঃ এটা গন মানুষের শোষকদের রক্ষা করে, সুবিধা ভোগী সৃজন করে, নতুন শ্রেনী ও স্বার্থবাদি গৌস্টির জন্ম দান করে থাকে। যারা রাষ্ট্রের এই চরিত্রটা সঠিক ভাবে অনুধাবন করতে পারেন না, তাঁরা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার প্রকৃত রূপ বুঝতে পারবেন না । তাঁরা সামাজিক পরিবর্তনের সত্যিকার পথ ও পন্থা নির্ধারন ও করতে পারবেন না

এনার্কিজম বা নিরাজবাদ মানব সমস্যার সমাধানের জন্য কোন চিরন্তন বানী নয়, এটা আবার কোন কল্পনা প্রসূত মতবাদ ও নয়, এই মতবাদ যেকোন চিরন্তন বানী বা মতবাদ বিরুধী। এটা কোন চিরন্তন সত্যে বিশ্বাসী নয়, বা মানবজাতির চূড়ান্ত মতবাদ হিসাবে ও দাবী করে না । এটা মানুষের জীবন যাত্রার কিছু সুনির্দিস্ট ব্যবস্থাপনার প্রস্তাব হাজির করে, যাতে উন্নততর চিন্তা চেতনার প্রকাশ ঘটায়, আর সেই কারনেই আগে থেকেই সকল কিছু বলে দেয়া সমীচীন নয়; বা চূরান্ত লক্ষ্য স্থির করা ও প্রায় অসম্ভব। প্রতিটি রাষ্ট্রের সব চেয়ে বড় খারাপ অপরাধটি হলো সামাজিক বৈচিত্রকে উপেক্ষা করে নির্ধারিত একটি কাঠামোকে বাস্তবায়নে অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করে । এটা মানুষের ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাভাবনাকে প্রতিনিধিত্ব করে না । মানুষের অবেগ অনুভূতিকে একেবারেই গুরুত্ব দিতে চায় না । রাষ্ট্র তাঁর সমর্থক ও সহযোগীকে অধিকতর শক্তিশালী করতে থাকে, তাঁর উত্তরাধিকারীকে সামাজিক ভাবে নানা কার্যক্রমের ভেতর দিয়ে সুপ্রতিস্টিত করে থাকে। সকল সময়েই সৃজনশীল মানুষকে চেপে রাখার প্রবনতা দেখিয়ে এসেছে রাষ্ট্র শক্তি, এটা সামগ্রীকভাবে কোন যুগকে কখনই বুদ্বিবৃত্তিক ভাবে উপলব্দি করতে চায়নি বা পারেও নি ।

বর্তমানে তথাকথিত একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহ সাধারন মানুষের মাথার উপর ঝেঁকে বসে আছে, জনগনের জ্ঞান, বুদ্বি ও সকল প্রচেস্টার কোন মূল্য এই রাষ্ট্র যন্ত্রের নিকট নেই, এই রাষ্ট্র গুলো যান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি বিশেষ রাজনৈতিক ধরনের ছাঁচে সকল কিছু কে বিবেচনায় নিয়ে থাকে । এটা মানুষের আকাঙ্ক্ষা কে নির্দয় ভাবে উপেক্ষা করে চলে । এই সর্বগ্রাসী রাষ্ট্র সমূহ ক্রমে জন সমর্থন হারাচ্ছে, এর স্পষ্ট ও ভয়ঙ্কর আচরন এবং বর্বরতা প্রকাশিত হচ্ছে, রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কিছু লোক তা ব্যবহার ও করছেন, মানবিক চিন্তার যৌক্তিকতা, অনুভূতি, ও আচার আচরনকে একেবারেই তোয়াক্কা করছে না । আদতে এই প্রক্রিয়াটা হলো মানুষের বুদ্বি বৃত্তিকে হত্যার শামিল ।

এনার্কিজম বা নিরাজবাদ সত্যিকার ভাবে মানুষের চিন্তা, চেতনা ও অনুভূতির সঠিক মূল্যায়ন করে থাকে, তা হোক প্রতিস্টানে বা সামাজিক পরিমণ্ডলে। এই মতবাদ বা পথ ধারা সুনির্দিস্ট বা স্থিরীকৃত নয়, এটা ঐতিহাসিক প্রয়োজনে মানুষের চিন্তাধারার বিবর্তনের ফলে বিকশিত হয়েছে। এটা মানুষের মাঝে সুপ্ত প্রতিভা এবং যোগ্যতাকে বিকশিত করে ব্যাক্তিগত ও সামাজিক জীবনকে প্রস্ফুটিত করতে চায়। যদি ও স্বাধীনতা একটি আপেক্ষিক বিষয়। তা কোন ভাবেই চিরন্তন বিষয় নয়। তবে তা ক্রমাগত বিস্তৃত ও পরিশিলিত হয়ে জীবনের চারিদিককে প্লাবিত করে দিতে পারে। একজন এনার্কিস্ট বা নিরাজবাদির জন্য স্বাধীনতা কোন কল্পনা বিলাশ বা দর্শনের বিষয় নয়, এর মৌলিক চিন্তাই হলো মানুষে পরিপূর্ন উন্নয়ন ও বিকাশ । রাজনৈতিক প্রভূত্ব ও চাপের কারনের মানুষের স্বাভাবিক বিকাশ বাঁধা গ্রস্থ হয়, কিন্তু মানুষ যদি একটি সংহতি পূর্ন পরিবেশে জীবনযাপন করতে পারে তবে তাঁদের সাংস্কৃতিক ও বুদ্বিবৃত্তিক বিকাশ অনেক ভালো হয় ।

সেই কারনেই বলা হয়ে থাকে, ইতিহাসে যত সাংস্কৃতিক অবনতি হয়েছে তা রাজনৈতিক দূর্বলতার কারনেই হয়েছে। এবং এটা ছিলো খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় যত যান্ত্রিকতা লক্ষ্য করা গেছে, তা সামাজিক কারনে ঘটে নাই। রাষ্ট্র ও সাংস্কৃতি পরস্পরের মধ্যে একধরনের সুপ্ত রয়েছে। নিথশে বলেছিলেনঃ

"কেউই শেষ পর্যন্ত তার চেয়ে বেশি ব্যয় করতে পারে না। এটি ব্যক্তিদের পক্ষে ভাল, এটি জনগণের পক্ষে ভাল। যদি কেউ নিজের পক্ষে ক্ষমতা, উচ্চ রাজনীতির জন্য, বাণিজ্যের জন্য, সংসদীয়, ও সামরিক ফায়দা হাসিলের জন্য ব্যয় করে। তবে, যে পরিমাণ যুক্তি, আন্তরিকতা, ইচ্ছা, আত্ম মর্যাদা, যা দিয়ে নিজের আত্মাকে গঠন করে, সে অন্যের জন্য তা করে না। সংস্কৃতি এবং রাষ্ট্র এক –এই কথায় কেহই প্রতারিত হবেন না- এটা পরস্পর বিরোধী। 'সংস্কৃতিগত রাষ্ট্র' কেবল একটি আধুনিক ধারণা নয়, এটা এটা প্রয়োজনে গড়ে তুলা হয়েছে। এটা ও সত্য যে, একের জীবন যাপনের অন্যতম উপাদান হলো অন্যের সহায়তা, অন্যের সহভাগীতা । একটি সংস্কৃতির দীর্ঘকালীন চর্চা রাজনৈতিক পতনের কারন হতে পারে। একই সংস্কৃত অর্থ মানে হল কোন একটি ভাবধারা বা আচরনিক চর্চাকে যতই মহান যা নৈকট্যবাদী ভাবা হোক না কেন। তা যদি তা রাজনীতি নিরপেক্ষ ও হয় তবু তাঁর উন্নয়ন ও হাল নাগাদ করনের ব্যবস্থা রাখা একান্ত দরকার। "

একটি রাজনৈতিক শক্তি বিশাল , ক্ষমতাশালী চক্র, একটি উন্নত সংস্কৃতির বিকাশে বাঁধা হতে পারে। যখন রাষ্ট্র তাঁর আভ্যন্তরীণ সমস্যায় আক্রান্ত হয়, তখন রাজনৈতিক শক্তি নানা ব্যবস্থা গ্রহন করে তা উত্তরনের প্রায়স চালায়। তাঁরা সংস্কৃতিকে ব্যবহার করে, এটা শাসকদের জন্য উপযোগী ব্যাখ্যা দাড় করায়, সামাজিক পরিমণ্ডলে রাষ্ট্রে অভিভাবকত্বের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরনের জন্য আমাদেরকে অধিক সৃজনশীল সংস্কৃতিক চর্চা করতে হবে । যা মানুষের জীবন ও সামাজিক কর্ম কান্ডে প্রতিফলিত হতে পারে। যা মানুষের স্বাধীনতার কথা বলে, বহুমূখী ভাবনার বিকাশ করে আমূল পরিবর্তনের সূচনা করে দেয়।

প্রতিটি সংস্কৃতির একটি নিজস্ব প্রকৃতি ও শক্তি আছে। কেবল আর্থিক উন্নতি সমাজে ও সংস্কৃতিতে তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না । এটা স্থায়ী রূপ লাভ করে, নিজেকে অনেক ক্ষেত্রেই নবায়ন করে নেয়। এটা অনেক সময় নানা মূখী কর্মের ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলে। এটা প্রতিটি সফল কর্মের পর আরও নয়া নয়া ক্ষেত্রের অনুসন্দ্ব্যান চালায়; এবং প্রতিটি জায়গায়ই সে আরো সাফল্য প্রত্যাশা করে থাকে । আদতে রাষ্ট্র কোন সংস্কৃতিরই জন্ম দাতা নয়। এটা আসলে চিন্তাবিহিন এক ধরনের যন্ত্র। এটা যেমন আছে তেমনই থাকতে পছন্দ করে, নিজেকে নিরাপদ রেখে সরল ও সাদাসিদে ভাবে সময় কাঠাতে চায় ।ইতিহাস বলে, প্রতিটি বিপ্লবের পর পরই যত পরিবর্তন সাধিত হয়েছে ।

ক্ষমতা সকল সময়েই নষ্টামির জন্মদাতা, এটা সকল সময়েই আইনের পোষাক পড়ে মানুষের প্রানবন্ত ভাবধারাকে দমন করে ফেলে। ক্ষমতাবানগন প্রায়স মতান্দ্বতার পরিচয় দেয়, এঁদের দমন প্রক্রিয়া হয় নির্মম। তাঁদের মুর্খতা মূলক কর্মকান্ড, এঁদের সমর্থক শ্রেনীর ক্রিয়া কলাপ নিস্টুর ও মুর্খতামূলক হয়ে থাকে। এরা কূপমণ্ডূক। এরা সত্যিকার জ্ঞানী গুনি ও বুদ্বিমান লোকদেরকে মূল্যায়ন করেনা। কর্তৃত্বতান্ত্রিক ব্যবস্থা সকল সময়েই যান্ত্রিকভাবে সকল কিছু বিবেচনা করে থাকে, এরা মানবিকতার কোন প্রকার তোয়াক্কা করে না ।

এই সকল পরিস্থিতি বিবেচনা করেই একটি নৈতিক ভিত্তি নিয়ে আধুনিক নিরাজবাদের অভিপ্রাকশ হয়েছে, কেবল স্বাধীনতাই মানুষকে একটি মহান ও মহৎ বুদ্বি বৃত্তিক পরিনতির দিকে নিয়ে যেতে সক্ষম। একটি শাসক চক্রের মানুষের জীবন প্রনালী কোন ভাবেই সুশীল মানুষের জীবনের মত হয় না । শাসক সর্বদা অস্থির থাকে প্রজাদের বা অধীনস্থ শ্রেণির লোকদেরকে কি করে বাধ্য করে রাখা যায়, তাই প্রানহীন যন্ত্রের মত আচরন করে চলে অবিরত, কেননা প্রজাদের আনুগত্যই তাঁদের অস্থিত্বের প্রধান নিয়ামক। এরা স্বাধীন মানুষ পছন্দ করে না । অথচ স্বাধীনতাই হলো জীবনের মৌলিক উপাদান। বুদ্বিবৃত্তিক ও সামাজিক জীবনের উন্নয়ন করতে হলে স্বাধীকারের কোন বিকল্প নেই। মানুষের জন্য সুন্দর আগামী গড়তে হলে এই দৃষ্টিভঙ্গীকে বাদ দিয়ে হবে না। মানুষের অর্থনৈতিক শোষন, বুদ্বিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে মুক্তি জন্য বা মানুষের বিশ্বদর্শনের জন্য নিরাজবাদ বা এনার্কিজম হল একটি চমৎকার পথ ও পন্থা। একটি উন্নততর মানবিক সমাজ নির্মান, এবং একটি উন্নত সংস্কৃতিক পরিমন্ডল বিনির্মানের জন্য মানুষের সত্যিকার স্বাধীনতা হল পূর্বশর্ত।

Comments

Related content