“নৈরাজ্যবাদ” হল এমন একটি সামাজিক অবস্থা সরকারের নিপিড়ন মূলক উঁচু নিচু প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তে স্বনিয়ন্ত্রিত ও সম্মিলিত সামাজিক সম্পর্ক বিরাজ করবে; “নৈরাজ্যবাদি” হল সেই সকল ব্যাক্তি যারা নৈরাজ্যিক দর্শন আনুসারে সামাজিক আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। কর্তৃত্ববাদ বিরুধী লোকেরা কোন প্রকার নিপিড়ন মুলক যাজকতন্ত্রের অনুগত থাকতে চায় না । ঐতিহাসিক পঠভূমি অনুসারে আমারা জানি এই যাজকতন্ত্রের বিরুদ্বে আন্দোলন ইউরূপেই প্রথম সূত্রপাত হয়। সেই সময়ে সামাজিক শ্রেনী বিভক্তির বিরুদ্বে নানা প্রকার আন্দোলন ও গড়ে উঠেছিলো। তবে সকলেই ‘নৈরাজ্যবাদি’ ছিলেন না ।
নৈরাজ্যবাদ নিয়ে কিছু আলাপ
এ কে এম শিহাব
এই প্রশ্নের জবাবে বহু প্রবন্দ্ব ও পুস্তক প্রণীত হয়েছে, নৈরাজ্যবাদ নির্মান করতে, প্রচার করতে, বাস্তবায়ন করতে এবং সংজ্ঞায়িত করতে লক্ষ লক্ষ মানুষ তাঁদের জান কোরবান করেছেন। নৈরাজ্যবাদের সূচনা করতে এই পথে বহু মানুষ অসীম ত্যাগ স্বীকার করেছেনঃ উনবিংশ শতাব্দিতে ইউরূপের শ্রমজীবী মানুষ পুঁজিবাদের কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার বিরুদ্বে এবং রাজনৈতিক দল গুলোর বিপরীতে তাঁদের আদর্শিক লড়াই চালিয়েছেন; আদিবাসি ও উপনিবেশের মানুষ লড়াই করেছে তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি ধরে রাখতে, ছাত্র জনতা তাঁদের ভাষা সংস্কৃতিকে সুরক্ষার জন্য জীবন দিয়েছেন; চীনের ডায়োস্ট বা এনাবাপট্রিস্ট গৌত্রের লোকেরা প্রায় পাঁচ শত বছর আগে সরকার ও তাঁদের চাপিয়ে দেয়া ধর্মের বিরুদ্বে সংগ্রাম করেছেন; বাম পন্থীদের কর্তৃত্ববাদ ও যৌনতার বিরুদ্বে লড়াই চালিয়েছেন। নৈরায়বাদের কোন কেন্দ্রীয় কমিটি নেই, নেই কোন চিরস্থায়ী নীতিমালা। নৈরাজ্যবাদ হল নানা মানুষের নানা মতামতের গুরত্ব দান করা। তবে, নিম্নে কিছু বিষয় তুলে দেয়া হল যে সকল বিষয়ে নৈরাজ্যবাদিরা প্রায় সকলেই একমত।
স্বাধীন এবং সার্বজনীনঃ সকল মানুষের ই স্বাধীন ভাবে মতামত প্রদান এবং দলবদ্ব হবার অধিকার রাখে। চাপিয়ে দেয়ার পরিবর্তে সকলকে নিয়ে সিদ্বান্তগ্রহন প্রক্রিয়া বজায় থাকবে, কেহই কোন ভাবে প্রাধান্য প্রতিস্টা করতে পারবেন না; তারা নিজেদের ক্ষমতা নিজেরা স্বাধীন ভাবে চর্চা করতে পারবেন, তবে তা অন্যদের উপর নয়। নৈরাজ্যবাদ পিতৃতান্ত্রিক, সাদাদের প্রধান্য, রাষ্ট্র ব্যবস্থার খবরদারী, সামাজিক নিপিড়ন মূলক উঁচু নিচু পন্থার সম্পূর্ন বিরুধী।
সম্মিলিত সহযোগীতাঃ মানুষ স্বেচ্ছায় একজন আরেক জনকে সহায়তা করবেন; মানুষের সম্পর্ক আইন, কারাগারের ভয়, অত্যাচারিত হবার বা এক ঘরে হয়ে যাবার ভয়ে গড়ে উঠবে না, বরং পারস্প্রিক সংহতি ও দয়া মায়ার ভিত্তিতে গড়ে উঠবে। সম্মিলিত সহযোগীতা কোন দান দক্ষিনা বা কিছু পাওয়ার জন্য ও হবে না; সেবা গ্রহিতা বা দাতা সকলেই সমান হবেন এটা হবে আন্তঃ বিনিময় ব্যবস্থা হিসাবে। কেহ কাহারো উপর ক্ষমতা খাটাতে যাবেন না, তারা তাঁদের সম্মিলিত শক্তিকে বৃদ্বি করবেন আরো সুন্দর ভাবে সম্মিলিত কর্ম সম্পাদনের জন্য।
স্বেচ্ছা সংস্থাঃ জনগনের স্বাধীনভাবে কারো সাথে সম্পৃক্ত হবার না হবার অধিকার থাকবে, মানুষে মাঝে মুক্ত সম্পর্কের পরিবেশ বজায় থাকবে; সম্পর্ক রাখা না রাখার ও স্বাধীনতা থাকবে, প্রতিটি মানুষ ব্যাক্তিগত ভাবে বা সামাজিক ভাবে সম্পূর্ন স্বাধীনভাবে চলার ফেরার স্বাধীনতা ভোগ করবেন। কোন প্রকার ভৌগলিক, লিঙ্গগত বা বর্ন গত বোর্ডার বা সিমান্ত থাকবে না ।
সরাসরি কাজঃ নৈরাজ্যবাদ কোন ভনিতা করে না বরং সরাসরি কাজে মন দেয়। লক্ষ্য অর্জনে নৈরাজ্যবাদিরা কোন প্রকার মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি ও লাগাতর কাজ করে যায়। একজন স্বাধীন মানুষ দুনিয়াকে স্বাধীন দেখতে চায়, তারা পরিবর্তনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়।
বিপ্লবঃ প্রচলিত নিপিড়ন মুলক ব্যবস্থার কেবল সংস্কার করে দিলেই হবে না । যারা নানা প্রতিস্টানের ক্ষমতার মসনদে আসীন আছেন তাঁদের দ্বারা সত্যিকার সংস্কার সম্ভব নয়, তারা কোনভাবেই চাইবেন না যে তাঁদের ক্ষমতা কমে যাক বা খাট হোক। সাদা অভিজাততন্ত্র এবং পুঁজিবাদ রীতিমত নিজেদের প্রভূত্ব বজায় রাখার জন্য লড়াইয়ে লিপ্ত; নৈরাজ্যবাদিগন বিপ্লবের মাধ্যমে সকল প্রকার অভিজাততন্ত্রের বিলয় ঘটিয়ে একটি মুক্ত ও স্বাধীন সমাজ গড়ে তুলতে চায়।
ব্যাক্তিগত স্বাধীনতাঃ একটি পুরাতন শ্লোগান আছে, “ শ্রমজীবী মানুষের স্বাধীনতা শ্রমজীবীগনকেই আদায় করে নিতে হবে”। এটি অন্যত্র ও কাজে লাগানো যায়; মানুষ তাঁর স্বাধীনতা নিজেই চিনিয়ে আনবে। স্বাধীনতা কেউ কাউকে দেয় না; এটা অর্জন করতে হয়।
কট্টর আদর্শবাদে বহুত্ববাদ ও স্বাধীনতার স্থান নেই। ঐতিহাসিক ভাবে নৈরাজ্যবাদের অনেক উদাহরন পাওয়া যাবে। অনেক সমাজে, সরকারে, ও সংস্থায় অনেকেই মুক্ত ভাবে জীবন যাপন করেন কিন্তু নিজেকে “নৈরাজ্যবাদি” দাবী করেন না । এই শব্দটি উনবিংশ শতাব্দিতে আত্মসচেতন ভাবেই ইউরূপে উদ্ভাবিত হয়। যার লক্ষ্যই ছিলো মানুষের সার্বজনীন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটানো।
ধারনা করা হয় যে মানুষ নৈরাজ্যিক জীবন যাপন করলেও “নৈরাজ্যবাদি” লেভেল নিজেদের পছন্দ নয় বলেই তা গ্রহন করে নাই; আমরা গভীরভাবে দেখলে দেখব যে ভিন্ন পরিভাষায় ব্যবহারিক জীবনে মানুশ নৈরাজ্যবাদ চর্চা করছেন।
“নৈরাজ্যবাদ” হল এমন একটি সামাজিক অবস্থা সরকারের নিপিড়ন মূলক উঁচু নিচু প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তে স্বনিয়ন্ত্রিত ও সম্মিলিত সামাজিক সম্পর্ক বিরাজ করবে; “নৈরাজ্যবাদি” হল সেই সকল ব্যাক্তি যারা নৈরাজ্যিক দর্শন আনুসারে সামাজিক আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত। কর্তৃত্ববাদ বিরুধী লোকেরা কোন প্রকার নিপিড়ন মুলক যাজকতন্ত্রের অনুগত থাকতে চায় না । ঐতিহাসিক পঠভূমি অনুসারে আমারা জানি এই যাজকতন্ত্রের বিরুদ্বে আন্দোলন ইউরূপেই প্রথম সূত্রপাত হয়। সেই সময়ে সামাজিক শ্রেনী বিভক্তির বিরুদ্বে নানা প্রকার আন্দোলন ও গড়ে উঠেছিলো। তবে সকলেই ‘নৈরাজ্যবাদি’ ছিলেন না । এমন একটি সমাজের কথা চিন্তা করা হয়েছে যেখানে কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকবে না যাকে বলা হয় নৈরাজ্যবাদি বা “রাষ্ট্র বিহীন” সামজ। যদি কোন ঘটনা চক্রে সত্যি রাষ্ট্র থেকেই যায় তবে অত্যন্ত সচেতন ভাবে লক্ষ্য রাখা হবে যেন কোন ভাবেই সামাজিক শ্রেনীর উদ্ভব না হয়। সেই সমাজকে মুক্ত ও নৈরাজ্যবাদি হিসাবে সুরক্ষা দেয়া হবে।
এখানে একটি দীর্ঘ সময় কালের মধ্যে সংঘটি সমাজ বিষয়ে কতিপয় নির্বাচিত উদাহরন উপস্থাপন করা হবে – তা প্রায় নব্বইটির মত হবে। এর মধ্যে ত্রিশটি হুবহু নৈরাজ্যবাদি সমাজ, আর বাকি গুলো ছিলো রাষ্ট্র বিহিন, স্বশাসিত, বা সচেতনভাবেই কর্তৃত্ববাদ বিরুধী সমাজ। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই হল বর্তমান পাশ্চাত্য সমাজ ভুক্ত, তিনভাগের এক ভাগ হলো পাশ্চাত্য সমাজের বাহিরে আর বাকি গুলো হলো দ্রুপদি ঐতিহাসিক সমাজের উদাহরন। এদের মধ্যে কিছু সমাজ স্পেনের গৃহ যুদ্বের সময় বিলয় হয়। যাদের সম্পর্কে সুনির্দিস্ট দলিল পত্র মজুদ আছে। আগ্রহী পাঠক অধ্যয়ন করে জেনে নিতে পারেন।
এই গ্রন্থের মুল বক্তব্যই হলো নৈরাজ্যবাদ কেমন করে পুঁজিবাদ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্বে লড়াই করে। এখানে বেশ কিছু উদাহরন তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে পুলিশ কেমন করে ধ্বংস আর সেনাবাহিনী কিভাবে নানা ভাবে নিপিড়ন নির্যাতন করে নিজেদেরকে বিজয়ী করার চেষ্টা করে। সেই জগন্য কর্মের জন্যই নৈরাজ্যবাদিরা বলেন বিপ্লবকে অবশ্যই বিশ্ব ভিত্তিক হতে হবে। পুঁজিবাদ একটি বৈশ্বিক ব্যবস্থা, এটা ক্রমাগত দুনিয়ার নানা স্থানে নানা ভাবে উপনিবেশ কায়েম করে ইহা স্বাধীন ও স্বশাসিত সমাজ ব্যবস্থার শত্রু। দির্ঘ সময় নিয়ে চিন্তা করলে বলতেই হয় যে কেবল একটি মাত্র দেশে নৈরাজ্যবাদ কায়েম করা বা ঠিকিয়ে রাখা অসম্ভব। পুজিবাদ বিরুধী বিপ্লব অবশ্যই পুঁজিবাদকে বিনাশ করবে, বা নিজেরা ধবংস হয়ে যাবে। নৈরাজ্যবাদ একক ভাবে বিশ্বব্যাপী মতবাদ নয়। নৈরাজ্যবাদ নানা জায়গায় নানা ধরনে সমাজ বিনির্মান করতে পারে, তবে কোথাও কোথাও সহ অবস্থান করলেও তা নৈরাজ্যবাদি সমাজ হিসাবে বিবেচিত হবে না। ইহা অবশ্যই কর্তৃত্ববাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হবে বা নিপিড়নের শিকার হবে। নিম্ন আমরা এই সকল বিষয়ে আলোকপাত করব।
এখানে আমরা বিশেষ কিছু দিক তুলে ধরব যা এই পুস্তক পাঠে সহায়ক হবেঃ
বিচ্ছিন্নন্তাঃ কিছু নৈরাজ্যবাদি প্রকল্প বেশ চমৎকার কাজ করে থাকে, কিন্তু এটা কেবল স্বল্প সঙ্খ্যার মানুষকে উপকার করতে পারে। এই বিচ্ছিন্নতার কি উৎপাদন করতে পারে ? কি কি অবদান রাখা যায় বা কি ফলাফল পেতে পারেন ?
জোটঃ এমন কিছু উদাহরন আছে, নৈরাজ্যবাদি ও কতৃর্ত্ববাদ বিরুধীরা বিশ্বাস ঘাতকতা করেছে, বিশ্বাস ঘাতকদের সাথে মিলিত হয়ে নিজেদেরকে ক্ষমতায় আসীন করার প্রয়াস চালিয়েছে। নৈরাজ্যবাদিরা কেন এই ধরনের জোটকে বেঁচে নিয়েছে? আমরা এ থেকে কি শিক্ষা নিতে পারি বা কি ধরনের জোট গড়ে তুলতে পারি?
দমনঃ স্বশাসিত সম্প্রদায় এবং বিপ্লবী কার্যক্রম পুলিশ ও সামরিক অভিযানের দ্বারা বন্দ্ব করে দেবার চেষ্টা করা হয়। মানুষ ভীত, অত্যাচারিত, গ্রেফতার, এবং খুন হয়েছে এবং নিজেদেরকে সময়মত লুকিয়ে রেখেছে এমন কি লড়াই সংগ্রাম থেকে সরে ও পড়েছে অনেকে; সম্প্রদায় সমূহ যদি বিপদের সময় সহযোগীতা না করেন, তবে কি কি কি কার্যক্রম ও কৌশল নেয়া হবে, দমন পিড়ন কি অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে মোকাবেলা করা যাবে? সেই কি করে বাহিরের সহায়তা ও সমর্থন আদায় করা যাবে তা নির্নয় করা হবে?
সহযোগীতাঃ কিছু আন্দোলন সংগ্রামী দল, র্যাডিকেল প্রজেক্ট আছেন, যারা প্রচলিত ব্যবস্থার সাথে মিলেমিশে কাজ করতে চান, নিজেদেরকে জনগণের সাথে বড় পরিসরে মিলাতে চান, বা নিপিড়ন নির্যাতনকে এড়িয়ে যেতে চান। এই ধরনের কর্ম পন্থার উপকারিতা কি ? এটা কি সত্যি বিচ্ছিন্নতা বা নিপিড়ন থেকে রক্ষা করতে পারে? এর কোন বিকল্প আছে কি ?
সাময়িক অর্জনঃ এমন অনেক উদাহরন এই বইয়ে আছে যার এখন কোন অস্থিত্ব নেই। নৈরাজ্যবাদিরা অবশ্যই কোণ স্থায়ী সংগঠন গড়ে তুলতে চায় না । সুনির্দিস্ট কাজের জন্য গড়ে তুললে ও কাজ শেষে তাঁর বিলুপ্তি ঘটে। ক্ষমতা দখলের পর নানা সমস্যার সমাধান কি কি প্রক্রিয়ায় করা হবে? ক্রমাগত লড়াই সংগ্রাম ও সম্প্রদায়ের ব্যবস্থাপনা কেমন করে হবে ?
Comments